পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে বাঁক যেন মৃত্যুফাঁদ!
স্থানীয় সূত্র ও হাসপাতাল তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে এই সড়কপথে ঘটেছে শতাধিক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৪৫০ জন এবং প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। আহতদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তি স্থায়ী পঙ্গুত্ব নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেক পরিবার হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব।
ভুক্তভোগী দেলোয়ার হাওলাদার জানান, ‘আমার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছে। ওষুধ আর চিকিৎসার খরচে সব জমিজমা শেষ। এখন পথে বসেছি।’

জুলাইয়ে ১৯ দিনে ১২টি দুর্ঘটনা
২১ জুন কেওয়াবুনিয়া বাঁকে ইজিবাইককে চাপা দেয় ইকরা লাক্সারী পরিবহন। নিহত হন একই পরিবারের শিশুসহ চারজন।
১১ জুলাই ছুটিকাটা বাঁকে ইমরান পরিবহন, অটোরিকশা ও পিকআপের সংঘর্ষে আহত হন কয়েকজন।
১৩ জুলাই চুনাখালী সেতুতে হিমাদ্রী কুন্ডু নামের এক ব্যক্তি দুর্ঘটনায় মারা যান।
২০ জুলাই মহিষকাটা বাঁক ঘুরতে গিয়ে হানিফ পরিবহন উল্টে যায়, আহত হন ৫ জন।
একই দিন রাতে মহিষকাটা বাঁকে ইউনিক ও লাবিবা পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ইউনিক পরিবহন খাদে পড়ে যায়। গত ১ জুলাই থেকে ২১ জুলাই—মাত্র ১৯ দিনে ঘটেছে ১২টি দুর্ঘটনা, নিহত হয়েছেন ২ জন।
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের তালিকা দীর্ঘ জানা যায়, শাখারিয়া, ব্রিকস ফিল্ড, কেওয়াবুনিয়া, মহিষকাটা, চুনাখালী, আমড়াগাছিয়া খানকা, ডাক্তারবাড়ি, ঘটখালী, তুলাতলী, একে স্কুল চৌরাস্তা, ছুটিকাটা, মানিকঝুড়ি, খুড়িয়ার খেয়াঘাট, খলিয়ান, কল্যাণপুর ও বান্দ্রা—এসব বাঁক দুর্ঘটনাপ্রবণ। চালকদের ভাষ্য, অনেক বাঁকে কোনো সতর্কতা চিহ্ন নেই, আর থাকলেও তা অস্পষ্ট এবং দূর থেকে দেখা যায় না।
চালক জাকির, রাসেল ও মজিবর বলেন, ‘বাঁকে প্রবেশের আগেই যদি আমরা সংকেত না পাই, তাহলে হঠাৎ বাঁকে দুর্ঘটনা হবেই। রাতে তো অবস্থা আরও ভয়াবহ।’
সিগনাল লাইট নেই, যা আছে তাও অকেজো
২০২৪ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগ পায়রা ফিলিং স্টেশন ও ছুটিকাটা এলাকায় দুটি সিগনাল লাইট বসায়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এরপর এক বছর পেরিয়ে গেলেও বাতি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের পায়রা ফিলিং স্টেশন ও ছুরিকাটা বাঁকে সিগনাল বাতি থাকলেও একটি সম্পূর্ণ অকেজো এবং আরেকটি ঝাপসা। অন্য কোথাও সিগনাল বাতির কোনো অস্তিত্ব নেই।
স্থানীয়দের দাবি: দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে
খুড়িয়ার খেয়াঘাট এলাকার আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে বাঁক খুব বিপজ্জনক, কিন্তু কোনো সতর্কতামূলক চিহ্ন নেই। প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে। অবিলম্বে এখানে বাঁক ঠিক করে চিহ্ন বসানো দরকার।’
বিআরটিসি চালক রহমত আলী বলেন, ‘সিগনাল বাতি না থাকায় চালকদের বাঁক বুঝতে সমস্যা হয়। ফলে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটে। দ্রুত প্রতিটি বাঁকে আলো ও সংকেতের ব্যবস্থা করা উচিত।’
বরগুনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কুমারেশ বিশ্বাস জানান, ‘সড়কের কিছু জায়গায় সিগনাল বাতি বসানো হয়েছে। বাকি যেসব বাঁকে এখনও বসানো হয়নি, সেখানে দ্রুত বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি মুছে যাওয়া চিহ্নগুলো নতুন করে আঁকা হবে।’
বাংলাদেশ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) বরগুনা শাখার সভাপতি সোহেল তানভির বলেন, ‘এসব বাঁক আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত। এগুলোতে দুর্ঘটনা রোধে সওজের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে যে উদাসীনতা, তা অমার্জনীয়। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিদিনই কেউ না কেউ প্রাণ হারাবে।’
পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের বাঁকগুলো এখন একেকটি মৃত্যুফাঁদে রূপ নিয়েছে। শতাধিক দুর্ঘটনা, অসংখ্য প্রাণহানি ও পঙ্গুত্বের পরেও কর্তৃপক্ষের নীরবতা সত্যিই উদ্বেগজনক। দ্রুত সিগনাল লাইট স্থাপন, বাঁক চিহ্নিতকরণ, স্পষ্ট চিহ্ন অঙ্কন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান জরুরি।








































