ঘূর্ণিঝড় মিধিলি: ২ বছরেও ফেরেননি ২৫ জেলে
নভেম্বর ১৭ ২০২৫, ১৮:০৭
পাথরঘাটা (বরগুনা): পাথরঘাটার উপকূলের জেলে পল্লীর নিখোঁজ জেলে পরিবারগুলোর আর্তনাদ এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই। এই তো মনে হয় ফিরছে সাগর থেকে। এই বুঝি দরজায় এসে ডাক দেবে, বলবে আমি সাগর থেকে আইছি, ধরো বাজার-সদাই আর ইলিশ মাছ। সাগর থেকে ফিরে আসার এমন স্মৃতি স্বজনরা ভুলতে পারেননি। এখনো অপেক্ষার প্রহর গুণছেন পাথরঘাটা উপকূলে না ফেরা জেলেদের স্বজনরা।
ঘূর্ণিঝড় মিধিলি…। নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন উপকূলের মানুষ। সেই সময় সাগরের মরণকূপ থেকে ফিরে আসা জেলেরা এখনো আঁতকে ওঠেন। দুই বছর হয়ে গেল কিন্তু আজও সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ফিরে আসেননি।
২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর আকস্মিক ঝড়ে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবিতে জেলেরা নিখোঁজ হন। তখন থেকে নিখোঁজ জেলে পরিবারগুলোর আর্তনাদ থামছে না। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ জেলেরা বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। প্রিয়জন ফিরে না আশায় তারা পথ চেয়ে আছেন। এর মধ্যে ২৫ জেলেই পাথরঘাটা উপজেলার।
নিখোঁজ জেলেরা হলেন- আবু কালাম (৬০), মজিবর চাপরাশি (৪৫), ইউসুফ আলী (৩৫), মো. জাফার (৩৫), আব্দুস ছত্তার (৬৫) নাদিম (২০) মো. বেল্লাল (২৫), মো. ইয়াসিন (২৫), আউয়াল বিশ্বাস (৪৮), সফিকুল ইসলাম (৪০), মো. ফারুক (৩৫), আব্দুল খালেক (৫০), মো. নান্টু মিয়া (৩৫), মাহতাব (৪৫), সিদ্দিক মৃধা (৪৩), কালু মিয়া (৪০), মো. মনির হোসেন (৪৫), সহিদুল ইসলাম (৪০), মো. সুবাহান খাঁ (৭১), মো. ইউনুস সর্দার (৭৩), মো. খলিল (৬১), আব্দুর রব (৬০), মো. আল আমিন (৩৫), মো. লিটন (৪১) ও মো. কালাম (৩৬)।
কথা হয় বঙ্গোপসাগরে মিধিলিতে নিখোঁজ বলেশ্বর নদ সংলগ্ন রুহিতা গ্রামের কালু মাঝির মেয়ে রাইসা মনির সঙ্গে।
তিনি বলেন, বাবায় গেছে কতদিন হলো, তবু সব সময় বাবার জন্য মন কাঁদে। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বাবাকে ডাক দেই, বাড়ির দরজায় দৌড়ে আসি- এই বুঝি বাবায় আইছে।
তিনি বলেন, দুটি বছর কীভাবে কাটছে- আমাদের সঙ্গে না থাকলে কেউ বুঝবে না। প্রায় দিনই না খেয়ে থাকি। মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তার ওষুধ কিনতেও পারি না। সংসার চালানোই কষ্ট, তারপরও মাকে দেখতে হয়। আমাদের মতো কেউ যেনো বাবা হারা না হয়।
কথা হয়, একই গ্রামের নিখোঁজ ইউসুফের ছোট ভাই ইয়াকুব আলীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, ভাই দুই সন্তান রেখে সাগরে গেছে। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে এলো না। সন্তানদের মুখের দিকে তাকালে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। সারাদিন বাবা বাবা বলে কান্না করে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি, পাইনি। জীবিত আছে না মারা গেছে তাও বুঝতে পারছি না। বাবা হারা সন্তানের আর্তনাদ, সান্ত্বনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই।
অপরদিকে বাবা-মাও সন্তানের আশার অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন। পথপানে চেয়ে থাকে এই বুঝি বড় ছেলে ইউসুফ আসছেন। শুধু ইউসুফ, কালু মাঝির পরিবারেই এমন আর্তনাদ নয়। জেলে পল্লীতে নিখোঁজ সব জেলের পরিবারেই চলছে এমন চিত্র।
উল্লেখ্য, কারো সন্তান, কারো বাবা, কারো জোড়ের ভাই হারানোর আর্তনাদ উপকূলের মানুষের সব সময়েরই। প্রতিনিয়ত এখানকার মানুষ স্বজনহারা কষ্ট নিয়ে বাস করছেন। এমন জীবিকার কাজ করছেন যে সাগরে যতবার যাওয়া, ততবার চিরবিদায় নেওয়ার মতো। শেষ যাওয়া মনে করেই জেলেরা পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান। পাথরঘাটায় ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নিখোঁজ জেলেদের তালিকা সম্বলিত স্মৃতিফলক করা হয়েছে।
জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান প্রশংসনীয়, এত অবদান সত্ত্বেও উপকূলের জেলেদের নিয়ে কেউ ভাবছেন না, ভাবার সময়ও নেই। উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন-জীবিকা, উপকূলের সম্পদ, জলবায়ু, পরিবেশসহ জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড এবং উপকূল মন্ত্রণালয় করা এখন সময়ের দাবি।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান বলেন, উপকূলের জীবন-জীবিকা, জেলেদের নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। প্রতিনিয়ত পরিবার হারাচ্ছে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। নিখোঁজ পরিবারকে বিভিন্ন সময় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। যা চলমান আছে।
২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর সকালে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি আঘাত হানে। তবে এর প্রভাবে সাগর উত্তাল ছিল ১৪ থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত। এতে অন্তত সাতজন নিহত এবং ১১৩ জন নিখোঁজ হন। আহত হন ৭০ জনের বেশি। যার মধ্যে পাথরঘাটার ২৫ জন জেলে রয়েছে, যাদের খোঁজ আজও মেলেনি।









































