ইলিশের আকাল, উৎপাদন তথ্য ‘অনুমাননির্ভর’!
জুলাই ০৯ ২০২৫, ১৭:২২
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে ইলিশের আকাল চলছে। হতাশা নিয়েই নদী থেকে ফিরতে হচ্ছে জেলেদের। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। অল্পকিছু মাছ ধরা পড়লেও দাম আকাশচুম্বী, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
আহরণ কম হলেও জেলার ২৫টি ঘাটে ইলিশের নিলাম বা ডাক ওঠে হালি বা পিস অনুযায়ী। কেজি দরে কখনোই বিক্রি হয় না ইলিশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি-বেসরকারি কোনো গণনাকারীকে ঘাটের জেলে-আড়তদার বা ব্যবসায়ীরা কখনো দেখেননি। এরপরও লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য বিভাগ প্রতি বছর ২৩-২৪ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন দেখায়। কর্মকর্তারা ‘অফিসে বসে’ অনুমান নির্ভর তথ্য দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
যদিও জেলা মৎস্য কর্মকর্তার বক্তব্য, উৎপাদন তথ্য সংগ্রহে ১২টি ঘাটে গণনাকারী রয়েছে।

অভিযোগ ‘এসি রুমে বসে মনগড়া হিসাব’
মেঘনা নদীর আড়তদার আলমগীর মোল্লা, জুলফিকার এবং জেলে আলী আহমেদ, আক্কাস, রবিউলসহ কয়েকজন জানান, নদীতে ইলিশ খুবই কম। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকা সংরক্ষণে বছরে আড়াই মাস নদীতে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এরপরও নদীতে ইলিশ বাড়েনি। এক একটি নৌকা সারাদিন জাল মেরে চার থেকে পাঁচটি, বড়জোর আট থেকে ১০টি ছোট ইলিশ পাচ্ছে। ইলিশ উৎপাদন কম বলেই দাম বাড়ছে।
সরকারি-বেসরকারি কোনো গণনাকারীকে ঘাটের জেলে-আড়তদার বা ব্যবসায়ীরা কখনো দেখেননি। এরপরও লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য বিভাগ প্রতি বছর ২৩-২৪ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন দেখায়। কর্মকর্তারা ‘অফিসে বসে’ অনুমান নির্ভর তথ্য দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে
ইলিশ শিকার করলেও তাদের পাতে জোটে না। ইলিশ বাড়লে জালেও বেশি ধরা পড়ত, দামও নাগালের মধ্যে হতো।
তারা অভিযোগ করেন, ‘এসি রুমে বসে মনগড়া হিসাবে প্রকৃত তথ্য আড়াল করছে মৎস্য বিভাগ। মাঠ পর্যায়ে কোনো তথ্যই কেউ সংগ্রহ করছে না।’

মৎস্য বিভাগের উৎপাদন তথ্য এবং বাস্তবতার ফারাক
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, লক্ষ্মীপুরে গত অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪) ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার টন। মাছঘাট রয়েছে ২৫টি। এতে প্রতিদিন জেলায় ৮২ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল। ২৫টি ঘাটের প্রতিটিতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন টন বা সাড়ে তিন হাজার কেজি ইলিশ উৎপাদন হয়।
কিন্তু ঘাটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিটি ঘাটে জেলেরা নদী ও সাগর থেকে এসে আড়তদারদের বাক্সে মাছ রাখেন। এরপর উন্মুক্ত নিলামে হালি (৪টি) হিসেবে ইলিশ বিক্রি হয়। ইলিশের আকালের কারণে প্রতিদিন সবগুলো ঘাটে ২০ টন ইলিশও পাওয়া যায়নি।
ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকা সংরক্ষণে বছরে আড়াই মাস নদীতে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এরপরও নদীতে ইলিশ বাড়েনি। এক একটি নৌকা সারাদিন জাল মেরে চার থেকে পাঁচটি, বড়জোর আট থেকে ১০টি ছোট ইলিশ পাচ্ছে। ইলিশ উৎপাদন কম বলেই দাম বাড়ছে
কটরিয়া মাছঘাটের দোকানদার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘এ ঘাটে কখনও ইলিশ নিয়ে গণনা ও ওজন পরিমাপ করতে কাউকে দেখিনি। গত ২০ বছরের মধ্যে কেউ কখনও জিজ্ঞেসও করতে আসেনি। সরকার অনুমান নির্ভর হয়ে ইলিশের উৎপাদন তথ্য দেয়।’
কটরিয়া ঘাটের বৃদ্ধ জেলে সালেহ আহম্মদ বলেন, ‘মৎস্য বিভাগ হয়তো ঢাকা-চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও কক্সবাজারের ইলিশের ওজন হিসাব করে সারাদেশে আনুমানিক উৎপাদনের তথ্য দেয়। সেখানেও সমস্যা আছে। সকল মাছ মোকামে যায় না। হিসাব করতে হবে ঘাট থেকেই।’
‘নদীতে ইলিশ নেই। জাল ফেলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জেলেরা’—মন্তব্য এই প্রবীণ জেলের।

কটরিয়া মাছঘাটের আড়তদার আলমগীর মোল্লা বলেন, ‘ইলিশের নিলাম ডাক হালি হিসাবে করা হয়। সব ঘাটেই একই নিয়ম। গত ১১ বছর কখনও কাউকে হিসাব নিতে দেখিনি।’
জুলফিকার বেপারি বলেন, ‘জেলা মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুমাননির্ভর। বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে মাছ ক্রয় করে চাঁদপুরে বিক্রি করি। কখনও কোনো কর্মকর্তা বা গণনাকারীকে ঘাটে এসে ইলিশের হিসাব নিতে দেখিনি।’
ইলিশের পাইকারি ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, ‘মেঘনা নদীতে ইলিশের উৎপাদনের হিসাব করার সুযোগ নেই। কারণ, জেলার প্রায় প্রত্যেকটি ঘাটে বঙ্গোপসাগরের জেলেরা মাছ নিয়ে আসেন। সবগুলোকে নদীর মাছ বলে মনগড়া হিসাব দেয় মৎস্য বিভাগ। সঠিক হিসাব কখনও পাওয়া যায় না।’
মতিরহাট মাছঘাটে ৪২টি বাক্স রয়েছে। আড়তদার মো. খোকন, মিহির ও ফারুক হোসেন বলেন, মতিরহাট মাছঘাটে মৎস্য বিভাগ বা অন্য কোনো সংস্থার কোনো গণনাকারী নেই। লক্ষ্মীপুরের কোনো মাছঘাটেই কেউ কখনও কোনো হিসাব করে না, কেউ জানতেও চায় না। ঘাটে ইলিশ বিক্রি হয় পিস বা হালি হিসাবে। এখানে ওজনে মাছ বিক্রি হয় না। মৎস্য বিভাগ কখনও মাঠ থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহই করে না।
রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার সেন্টার খাল মাছঘাটের আড়তদার সফিক উল্যাহ বলেন, ‘এখানে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আসে। ওজন করে কোনো মাছ বিক্রি হয় না। ৫২ জন আড়তদার একইভাবে পিস বা হালি হিসেবে মাছ বিক্রি করেন। এখানে সরকারি বা বেসরকারি কোনো গণনাকারী নেই।’

জেলার সবচেয়ে বড় মাছঘাটের টাংকি বাজারের আড়তদার তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘এ ঘাটে নদী ও সমুদ্রের মাছ আসে। এখানে ইলিশ পণ (৮০টি) হিসাবে বিক্রি হয়। মৎস্য বিভাগ কীভাবে ওজন হিসাবে ইলিশের উৎপাদন নির্ণয় করে, তা আমার জানা নেই।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার বক্তব্য
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘জেলায় ২৫টি মাছঘাট আছে। এর মধ্যে সদর, কমলনগর ও রামগতির ১২টি বড় মাছঘাটে মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে ১২ জন গণনাকারী রয়েছেন। প্রতি সন্ধ্যায় তারা মৎস্য অফিসে ইলিশ আহরণের হিসাব পাঠান। এর মাধ্যমেই মৎস্য বিভাগ ইলিশ উৎপাদনের হিসাব করেন। সাত বছর ধরে একইভাবে হিসাব নির্ণয় করা হচ্ছে।’
২০২৩-২৪ মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলায় ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার টন—জানান এই কর্মকর্তা।








































