চিনি-তেল কোথাও মিলছে, কোথাও উধাও
নভেম্বর ১৯ ২০২২, ০০:৫৪
ডেস্ক প্রতিবেদক ॥ বেশ কিছুদিন ধরে নিত্যপণ্য ভোজ্য তেল ও চিনির কৃত্রিম সংকট চলছে রাজধানীসহ দেশের বাজারে। এই সংকটের মধ্যেই দাম বেড়েছে পণ্য দু’টির। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে বাড়ানো হয়েছে ১৩ টাকা, যা গত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর।
তবে কার্যকর হওয়া বাড়তি দামেও বাজারে মিলছে না ভোজ্য তেল ও চিনি। তবে কোনো কোনো দোকানে পাওয়া গেলেও ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে নির্ধারিত দরের চেয়েও বাড়তি দামে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খোলা বাজারে নির্ধারিত দাম থেকে ১০ টাকা বেশি এবং পাইকারি বাজারে ৩-৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে তেল-চিনি। এ ছাড়া বাজারে চাল, ডাল, আটা, ময়দা ও ছোলার দামও বেড়েছে। বিক্রেতারা জানান, দেশে ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে ভোজ্য তেল ও চিনির দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। আবার আমদানিনির্ভর অন্য পণ্যগুলোর দাম নির্ধারিত না থাকায় দফায় দফায় বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই মূল্যবৃদ্ধি আগে থেকেই সংকটে থাকা মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেবে। কারণ বাজারে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম ব্যাপক চড়া। সর্বশেষ ১৫ দিনে বাজারে আটা, ময়দা ও মসুর ডালের দাম বেড়েছে। এখন বাড়লো তেল ও চিনির দাম। চালের দাম কমেনি বললেই চলে। তবে কিছুটা কমেছে মুরগি ও ডিমের দাম, যদিও তা স্বাভাবিকের চেয়ে এখনো অনেক বেশি। এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা ছিল ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরে তা কমে ৯ শতাংশের নিচে নামে (৮ দশমিক ৯১ শতাংশ)।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স এসোসিয়েশনও ওইদিনই মন্ত্রণালয়কে জানায়, চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে দু’টি সংগঠনের নেতারা। বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ছে দুই বছর ধরে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সয়াবিন তেলের দাম লিটার ১০০ টাকার আশপাশে ছিল। এ বছর যা ২০৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। পরে অবশ্য কমেছিল। এখন আবার বাড়লো। গত জানুয়ারি মাসেও চিনির কেজি ছিল ৭৫ টাকা, যা বাড়তে বাড়তে এখন শতক ছাড়িয়েছে। ভোজ্য তেল ও চিনির বাড়তি দাম ১৭ই নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।
নতুন দামে এক লিটারের বোতল সয়াবিন তেল ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ১৭৮ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতল সয়াবিন তেলের নতুন দাম ৯২৫ টাকা। আগে ছিল ৮৮০ টাকা। খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৭২ টাকা, যা আগে ১৫৮ টাকায় বিক্রি হতো। অন্যদিকে প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১২১ টাকায়। এদিকে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনির দাম ১৩ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা। আগে দাম ছিল ৯৫ টাকা। যদিও বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দামে। কোথাও কোথাও কিছুটা কম দামে ১১৫ টাকায় চিনি বিক্রি করতে দেখা গেছে।
বাজারে দেখা দিয়েছে চিনির সংকটও। নতুন দাম অনুযায়ী, ৫০ কেজির চিনির বস্তার দাম হয়েছে ৫ হাজার ১শ’ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়বে ১০২ টাকা। তবে বাজারে নির্ধারিত দামে কোথাও তেল-চিনি বিক্রি করতে দেখা যায়নি। মধুবাগ বাজারের মুদি দোকানি হানিফ বলেন, আমরা খোলা তেল ১৯৫ টাকা লিটার এবং খোলা চিনি ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।
বোতলজাত তেল এবং প্যাকেটজাত চিনি গায়ের দামে বিক্রি করছি। আর কাওরান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা খালেক বলেন, খোলা সয়াবিন তেল পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৮৮-১৯০ টাকায় এবং খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৯৫-২০০ টাকায়। এ ছাড়া ২ লিটার ৩৫৫ টাকা এবং ৫ লিটার ৮৮০ টাকায় আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। নতুন দামের তেল এখনো বাজারে আসেনি। হয়তো কাল-পরশু নতুন দামের তেল বাজারে পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, আমরা পাইকারিতে খোলা চিনি বিক্রি করছি ১১০ টাকা কেজি দরে। তবে খুচরায় অনেকে ১২০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করছে। এর বাইরে সরকার খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির আওতায় যে আটা বিক্রি করে, তার দাম কেজিপ্রতি ৬ টাকা বাড়িয়েছে। প্যাকেট আটায় ৪ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৭০ টাকায় ঠেকেছে। প্যাকেট ময়দায় দাম ১০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৮০ টাকা হয়েছে। খোলা আটা কেনা যাচ্ছে ৬৫ টাকায়, আর ময়দা ৭৫ টাকায়। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যয় বাড়বে। সাম্প্রতিক কালে ওএমএসের চাল ও আটা কিনতে মানুষ ভোর থেকে লাইনে দাঁড়াচ্ছে।
এদিকে বাজারে মোটা চাল কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। প্রতি কেজি সাধারণ মানের পাইজাম বা মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৬০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫২ থেকে ৫৮ টাকা। আর মাঝারি মানের চাল কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা ও ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার উপরে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, বাজারে মোটা চাল কেজিপ্রতি সর্বনিম্ন ৪৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও বেশির ভাগ বাজারে এ দরে চাল পাওয়া যায় না। অন্যদিকে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে বেড়ে চলেছে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। নতুন করে বেড়েছে ছোলার দামও। খোলা বাজারে মসুর ডালের কেজি মানভেদে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা এবং ছোলার প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়ায় দামও অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কমে মিলছে না কোনো সবজি, যা আগে ৬০ থেকে ৮০ টাকা ছিল। ১২০ টাকার সিম কমে এখন ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। গাজর ও পাকা টমেটোর কেজি ১০০ টাকা, পটল, করলা, বেগুন, লতির কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা।
ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতিপিস ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, সপ্তাহ খানেক আগে এর দাম ছিল ৬০ টাকা, আমদানি পিয়াজের কেজি মানভেদে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। যেগুলো গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। দেশি রসুন কেজিতে ১০ টাকা কমে মানভেদে ৭০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা, দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ২২০ থেকে ২৪০ টাকা। রামপুরা বাজারের সবজি বিক্রেতা হোসেন মিয়া বলেন, মুড়িকাটা পিয়াজ আসতে শুরু করায় আমদানি ও দেশি পিয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে।
কাওরান বাজারে আসা রাশেদ বলেন, শুধু পিয়াজের দাম কমায় কিছু যায় আসে না। যে চাল-ডাল-তেল বেশি লাগে সেগুলোর তো আগুন দাম। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সেই সঙ্গে সোনালি মুরগি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা প্রতি কেজি, কক ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বাজারে খাসির মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায় আর গরু মাংস প্রতি কেজি ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে বাজারে কমতে শুরু করেছে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ টাকা। কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম ঠিক করে, আর সেটি সরকার কার্যকর করে। এটি একটি ‘আই ওয়াশ’। কারণ যতবার দাম কমানো বা বাড়ানো হয় বাজারে এটি কার্যকর হতে দেখা যায় না। বরং নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশিতে বিক্রি হয়েছে। যা কাম্য নয়।







































