তাই নিরবেই কেটে গেলো বরিশালের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২১ শে ফেব্রুয়ারি
ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর, অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই চেতনার প্রতীক
ফেব্রুয়ারি ২১ ২০২৩, ১৭:১২
রুপন কর অজিত ॥ অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। আজ মঙ্গবার বাংলাদেশের সাথে সারাবিশ্বে এই দিনটি পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলে রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর জব্বাররা। এসব শহীদের রক্তে মায়ের ভাষার অধিকার আদায় হয়েছিল সেদিন। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের এ সংগ্রাম পরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর সেনুযায়ী দেশের সরকারী, আধা-সরকারী , স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ দলীয়ভাবেও নানা কর্মসুচী পালিত হয়। শহীদের স্বরণে নির্দেশনা মোতাবেক স্ব স্ব দপ্তর দিবসটি পালন নানা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে থাকে।
দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও দেয়া হয় নানাবিধ নির্দেশনা। এর মধ্যে শহীদের স্বরনে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলীও কর্মসুচির অংশবিশেষ। তবে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকায় এর ব্যত্যয় ঘটে। এতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো থেকে বঞ্চিত হন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
মহান এ দিবসটিতে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরুপ এ কর্মসূচী বাস্তবায়িত না হলে অপূর্ণই রয়ে যায় ভাষা শহীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বহিঃপ্রকাশের বিষয়টি। আর সে অপুর্ণতা রয়েছে বরিশালেও। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার না থাকায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ভাষা শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারেনি। শহীদ মিনার নেই এমন অজুহাতে অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিবসটিতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে ছুটি ভোগ করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে ।
জেলার কলেজ , মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলো মিলিয়ে মোট ৭৭৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩১১ টিতেই শহীদ মিনার নেই বলে জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বরিশাল জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী বরিশাল সদর উপজেলায় কলেজ রয়েছে ২২ টি । এর মধ্যে শহীদ মিনার আছে ১৯ টিতে এবং ৩ টিতেই নেই। স্কুল রয়েছে ৯৩ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৭০ টিতে। ২৩ টিতে নেই। মাদ্রাসা আছে ৩৭ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৯ টিতে এবং বাকি ২৮ টিতে শহিদ মিনার না থাকায় সে প্রতিষ্ঠান গুলোতে কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়ে শ্রদ্ধাঞ্চলি কিংবা শ্রদ্ধা না জানিয়েই দিনটির সমাপ্তি ঘটে এমন অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মুলাদীতে কলেজ রয়েছে ৭ টি । এর মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৬ টিতে এবং নেই ১ টিতে, স্কুল রয়েছে ৩৯ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৩৪ টিতে এবং নেই ৫ টিতে, মাদ্রাসা আছে ২০ টি তার মধ্যে একটিতেও শহিদ মিনার নেই।
উজিরপুরে কলেজ রয়েছে ১২ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ০৮ টিতে এবং নেই ৪ টিতে, স্কুল রয়েছে ৫১ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৪৭ টিতে এবং নেই ৪ টিতে, মাদ্রাসা আছে ২১ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ১৪ টিতে এবং বাকি ৭ টিতে শহিদ মিনার নেই।
বানারীপাড়ায় কলেজ রয়েছে ৭ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৫ টিতে এবং নেই ২ টিতে, স্কুল রয়েছে ৩৫ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৩৩ টিতে এবং নেই ২ টিতে, মাদ্রাসা আছে ১৮ টি তার মধ্যে একটিতেও শহিদ মিনার নেই।
গৌরনদীতে কলেজ রয়েছে ৬ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৬ টিতেই , স্কুল রয়েছে ২৭ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ২৭ টিতেই, মাদ্রাসা আছে ১৪ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ০৫ টিতে এবং বাকি ১০ টিতে শহিদ মিনার নেই।
আগৈলঝাড়াতে কলেজ রয়েছে ২ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ১ টিতে এবং নেই ১ টিতে, স্কুল রয়েছে ৩৪ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ২৮ টিতে এবং নেই ৬ টিতে, মাদ্রাসা আছে ৬ টি তার মধ্যে একটি টিতেও শহিদ মিনার নেই।
বাকেরগঞ্জে কলেজ রয়েছে ২৪ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ১৪ টিতে এবং নেই ১০ টিতে, স্কুল রয়েছে ৮৪ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৬৯ টিতে এবং নেই ১৫ টিতে, মাদ্রাসা আছে ৬৩ টি তার মধ্যে একটিতেও শহিদ মিনার নেই।
বাবুগঞ্জে কলেজ রয়েছে ৪ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ০৩ টিতে এবং নেই ০২ টিতে, স্কুল রয়েছে ৬৩ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ২২ টিতে এবং নেই ১৪ টিতে, মাদ্রাসা আছে ১৮ টি তার মধ্যে একটিতেও টিতে শহিদ মিনার নেই।
মেহেন্দিগঞ্জে কলেজ রয়েছে ০৬ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ৫ টিতে এবং নেই ১ টিতে, স্কুল রয়েছে ৬৩ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ২৬ টিতে এবং নেই ১০ টিতে, মাদ্রাসা আছে ২৭ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ২ টিতে এবং বাকি ২৫ টিতে শহিদ মিনার নেই।
হিজলাতে কলেজ রয়েছে ২ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ০১ টিতে এবং নেই ০১ টিতে, স্কুল রয়েছে ২৭ টি তার মধ্যে শহীদ মিনার আছে ১৪ টিতে এবং নেই ০৩ টিতে, মাদ্রাসা আছে ০৯ টি তার মধ্যে একটিতেও শহিদ মিনার নেই।
অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরেও বরিশালসহ জেলার দশ উপজেলায় মোট ৭৭৯ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩১১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই শহীদ মিনার। সচেতন মহলের দাবী , ভাষা আন্দোলন ৭১ বছরে পা রাখলেও বরিশালে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো হয়নি শহীদ মিনার। ফলে মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির প্রতি দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও ভাষা সৈনিকদের অবদান সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা ’৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব সম্পর্কেও সঠিক ধারণাও নিতে পারছে না। তাই অতি সত্বর যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই সেসব প্রতিষ্ঠানে নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। এদিকে জানাযায়, অনেক প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকলেও তা জরাজীর্ণ। রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে অরক্ষিত অবস্থায়ই পড়ে থাকে বছরের পর বছর। এগুলো সংস্কারেরও কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়না। একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে ঘসা মাঝা করে কাজ চালনো হয়।
গত রবিবার বরিশালের মথুরানাথ পাবলিক স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শহীদ মিনার বানানো হচ্ছে। অথচ এর আগে প্রতিষ্ঠানটিতে শহীদ মিনার ছিলইনা।
একইদিনে বরিশাল নগরীর কলেজিয়েট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয়টিতে এখনো শহীদ মিনার হয়নি। তবে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম জানান, জায়গা না থাকায় এতদিন শহীদ মিনার করতে পারেননি তারা। তবে জায়গা নির্ধারণ হয়েছে। খুব শীগ্রই শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। এছাড়া প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও শিক্ষার্থীদের র্যালি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যাবো। কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনা সভা করবেন বলেও জানান তিনি।
একুশে ফেব্রুয়ারী দিন সকালে বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় একটি স্কুলের ৭ম শ্রেনীর এক শিক্ষার্থী জানায়, শহীদ মিনার না থাকায় প্রতি বছর অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিতে বা এভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসতে ভালো লাগে না। আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। স্কুলে শহীদ মিনার থাকলে আমরা আরো বড় আয়োজন করতে পারতাম। এসময় কর্তৃপক্ষের কাছে একটি শহীদ মিনার আবেদনও করেন এই শিক্ষার্থী।
শহীদ মিনার না থাকা একটি বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানান, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার এখনো হয়নি। অথচ বইয়ে ছোট বেলা থেকেই শহিদ মিনার দেখে আসছি। কিন্ত বাস্তবে আমরা আমাদের বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার দেখিনি। তাই শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছর এখানে আসতে হয়।
বরিশাল জেলা শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথমে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি না হলেও পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার হবে বলে জানান তিনি। তিনি জানান, এটি আমাদের চেতনায় যায়গা। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার হবে। কারণ এটি আমাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এ বিষয়ে বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক( শিক্ষা ও আইসিটি) মনদীপ ঘরাই বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই এমন পরিপূর্ণ তথ্য আমাদের কাছে আসেনি। আমাদের কাছে আসলে সরকারী বরাদ্দ হোক কিংবা যেকোনভাবেই হোক করার চেষ্টা করব।







































