ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিতে চলছে গাড়ি

ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিতে চলছে গাড়ি

অক্টোবর ১২ ২০২৫, ১৫:২৮

রাজধানী ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে যানজট যেন নাগরিক জীবনের স্থায়ী যন্ত্রণার নাম। অফিসগামী কর্মী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী সবার জন্যই প্রতিদিনের এই কষ্ট যেন এক অনন্ত দুর্ভোগ। কিন্তু সম্প্রতি ডিএমপি (ঢাকা মহানগর পুলিশ) সীমিত পরিসরে চালু করেছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি ব্যবস্থা, যা নগরজীবনে নতুন স্বস্তির বার্তা এনেছে।

নতুন সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরই রাজধানীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের যানবাহন চলাচলে এসেছে শৃঙ্খলা ও গতি। ড্রাইভার, যাত্রী, এমনকি পথচারীরাও বলছেন, এই উদ্যোগে ঢাকার রাস্তায় ফিরেছে স্বস্তি ও আনন্দ। ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিতে সময় বাঁচছে আর এতে আনন্দিত সাধারণ চালকেরা।

ঢাকার মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন গাড়ি চালান রাকিবুল ইসলাম, পেশায় একজন প্রাইভেট গাড়িচালক। তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, আগে শেরাটন বা ফার্মগেটের মতো মোড়ে যেতে ভয় পেতাম। দীর্ঘ যানজটে বসে থাকতে হতো ২০–৩০ মিনিট। কিন্তু এখন সিগন্যাল বাতিতে গাড়ি থামে, আবার নির্দিষ্ট সময়েই চলে আর এতে অসাধারণ লাগছে। যদি সব জায়গায় এমন সিগন্যাল হতো, তাহলে অফিসে বা স্কুলে পৌঁছাতে অর্ধেক সময় লাগতো।

একই আনন্দ প্রকাশ করেন একজন পিকআপ ভ্যান ড্রাইভার সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিটা সিগনালে যদি বাতি থাকে, ট্রাফিক পুলিশ হাত না তুলে, বাতি দেখেই গাড়ি চলেতাহলে ঝগড়া, থামানো, তর্ক কিছুই থাকবে না। একটু বসে থাকলেও কষ্ট লাগে না, কারণ জানিবাতি সব ঠিক করবে।

চালকদের এই সন্তুষ্টি ইঙ্গিত দিচ্ছে, যদি রাজধানীর সব গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি চালু করা যায়, তাহলে যানজট কমবে বহুগুণে, সময় বাঁচবে লাখো মানুষে। আর যেখানে বাতি চলছে, সেখানেই শৃঙ্খলা ফিরেছে।

ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যাল পয়েন্টে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি চালু করা হয়েছে। এসব হলো: শেরাটন সিগন্যাল। বাংলা মোটর সিগন্যাল। কারওয়ান বাজার সিগন্যাল। ফার্মগেট সিগন্যাল। বিজয় সরণি সিগন্যাল। দপ্তর কোচিং সিগন্যাল তেজগাঁও। জাহাঙ্গীর গেট সিগন্যাল।

এই সাতটি সিগন্যালই বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে বুয়েটের একটি গবেষণা প্রকল্পের আওতায়, যা “স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট” এর অংশ হিসেবে বাস্তবায়িত হয়েছে।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মো. ইনামুল হক দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, এটি সীমিত আকারে চালু করা হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, কোথায় এটি কার্যকর হচ্ছে, কোথায় উন্নতি দরকার। বুয়েটের সাথে যৌথভাবে আমরা ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে এই সিগন্যাল বাতি চালুর পরিকল্পনা করছি।

তিনি আরও জানান, এখনকার সাতটি পয়েন্টে যানবাহন চলাচলের সময় ও গতি উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে আমরা আশাবাদী এই ব্যবস্থা সফল হলে রাজধানীর যানজট ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।

যানজট কমেছে, বাঁচছে জ্বালানি ও সময়

নগর ট্রাফিক বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির মাধ্যমে কেবল সময়ই নয়, জ্বালানি খরচও অনেকটা কমানো সম্ভব। প্রতিটি মোড়ে গড়ে ৫–১০ মিনিট সময় বাঁচলে, পুরো ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় দশ লাখ লিটার জ্বালানি সাশ্রয় হতে পারে, যা অর্থনৈতিকভাবে বিশাল সুফল।

পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ যানবাহন চলাচল করে। যদি প্রতিটি গাড়ির সময় সাশ্রয় হয় গড়ে ১০ মিনিট, তবে প্রতিদিন লাখো ঘন্টা কর্মঘন্টা বাঁচবে, যা জাতীয় উৎপাদনশীলতাতেও বড় ভূমিকা রাখবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হান্নান আহমেদ বলেন, ট্রাফিক সিগন্যাল চালু থাকলে যানবাহনের প্রবাহ থাকে নিয়ন্ত্রিত। এতে জ্বালানি সাশ্রয় হয়, দূষণ কমে, এবং চালকদের মানসিক চাপও অনেক হ্রাস পায়।

বুয়েটের স্মার্ট প্রজেক্টে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বুয়েটের ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং (TTE) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর মোয়াজ্জেম দৈনিক আমার সংবাদকে জানান বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় এবং ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অর্থায়নে রাজধানীর ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক পয়েন্টে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে সাতটি পয়েন্টে সিগন্যাল বাতি চালু করা হয়েছে, যার ফলে নগরবাসী দৃশ্যমান সুফল পেতে শুরু করেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেখছি মানুষ এখন সিগন্যাল মেনে চলাচল করছে, যানজটও তুলনামূলকভাবে কমছে।

প্রফেসর মোয়াজ্জেম জানান, প্রকল্পের পরবর্তী ধাপে শিক্ষা ভবন থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত মোট ১৬টি নতুন পয়েন্টে সিগন্যাল বাতি স্থাপনের কাজ শুরু হবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী এক মাস ১৫ দিনের মধ্যেই এসব স্থানে কাজ শেষ হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর যান চলাচলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং নাগরিকরা আরও শৃঙ্খলাপূর্ণ ট্রাফিক ব্যবস্থার সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। পরবর্তীতে এটি “স্মার্ট সিটি ট্রাফিক সিস্টেম” এর অংশ হিসেবে উন্নীত করা হবে।

এই স্মার্ট সিস্টেমে থাকবে স্বয়ংক্রিয় সেন্সর যা যানবাহনের চাপ অনুযায়ী সিগন্যালের সময় নির্ধারণ করবে, ট্রাফিক ক্যামেরা যা রিয়েল টাইম পর্যবেক্ষণ করবে এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা একসাথে সব সিগন্যাল পরিচালনা করবে।

বুয়েটের এক প্রকল্প কর্মকর্তা বলেন, আমরা চাই প্রতিটি মোড়ে গাড়ি চলাচল হোক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। মানুষ ও মেশিন উভয়ের সমন্বয়ে তৈরি হবে ‘স্মার্ট ট্রাফিক ঢাকা’। এজন্য সরকারি সহায়তা ও নাগরিক সচেতনতা দুটোই জরুরি।

ড্রাইভারদের মুখে স্বস্তির ছাপ

ঢাকার প্রায় প্রতিটি মোড়ে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে গাড়ি থামাচ্ছেন বা দিচ্ছেন ছাড়। এই ম্যানুয়াল পদ্ধতি বহু বছর ধরে চললেও তা অনেক সময় তৈরি করে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা।

ড্রাইভার রাকিবুল ইসলাম বলেন, একটা সিগন্যাল বাতি সব কিছু সহজ করে দেয়। কেউ কারো সাথে ঝগড়া করে না। পুলিশের হাত ওঠে না, গাড়ি হঠাৎ থামে না সব নিয়ম মেনে চলে। এটা আধুনিক শহরের পরিচয়।

আরেক চালক হাসান আলী বলেন, আগে ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে ঘন্টাখানেক থাকতাম। এখন সিগন্যাল ঠিকমতো কাজ করছে, তাই গাড়ি চলে যায় নির্ধারিত সময়েই। আমরা সবাই চাই এই সিস্টেম সব জায়গায় হোক। আর নগরবাসীর দাবি, ‘সব মোড়ে সিগন্যাল বাতি চাই।’ রাজধানীর সাধারণ নাগরিকরাও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।

অফিসগামী ফারজানা নওশিন বলেন, আমরা প্রতিদিন সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করি। সিগন্যাল বাতি ঠিকঠাক কাজ করলে অন্তত অফিসে দেরি হয় না। সবারই উপকার।

একই কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অনিক দাস, যানজট মানেই ক্লাস মিস। সিগন্যাল সিস্টেম চালু হলে ছাত্রছাত্রীরাও স্বস্তি পাবে।

নগরবাসীর দাবি স্পষ্ট, ঢাকার প্রতিটি প্রধান মোড়ে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করতে হবে দ্রুততম সময়ে।

যানবাহনের শৃঙ্খলা ও নাগরিক দায়িত্ব

ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি চালু হলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চালকরা নিয়ম মানেন না, বা বাতি লাল থাকলেও গাড়ি চালিয়ে দেন, বা হঠাৎ থামেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তির পাশাপাশি মানসিক ও নাগরিক শৃঙ্খলাও অপরিহার্য।

বাতি বসানোই শেষ নয়। নাগরিকদের সহযোগিতা ছাড়া এটি সফল হবে না। সবাইকে নিয়ম মানতে হবে। একবার যদি সবাই নিয়ম মেনে চলে, তাহলে আমরা ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াও রাজধানী পরিচালনা করতে পারবো।

ঢাকায় স্মার্ট সিটি ট্রাফিক আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা

ডিএমপি, বুয়েট ও সিটি করপোরেশন একযোগে কাজ করছে ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়নে। এর মধ্যে রয়েছে, স্মার্ট ক্যামেরা, ডিজিটাল সিগন্যাল, ই-ফাইন সিস্টেম, অনলাইন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে রাজধানীতে যানজট ৩০–৪০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব। ভবিষ্যৎ লক্ষ্য: রাজধানীর সব পয়েন্টে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা।

এছাড়া নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সড়ক পুনর্বিন্যাস, ফুটওভারব্রিজ উন্নয়ন, ও ট্রাফিক শিক্ষা প্রচারণাও বাড়ানো হবে। আর আমরা চাই এই সিস্টেম ধীরে ধীরে পুরো রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে দিতে। একবার নাগরিকরা এর সুবিধা বুঝে গেলে, নিজেরাই নিয়ম মেনে চলবে।

নিয়ম মেনে চললে জ্যামমুক্ত ঢাকাও সম্ভব

ঢাকা শহর প্রতিদিন নতুনভাবে জেগে ওঠে, কখনো ক্লান্ত, কখনো আশাবাদী। যানজটের এই শহরে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি যেন এক টুকরো শৃঙ্খলার আলো।

চালক, যাত্রী, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী সবাই আজ একবাক্যে বলছে, বাতির আলোয় শহরটা যেন একটু হাসছে। যদি এই প্রকল্প সারা শহরে বিস্তৃত করা যায়, এবং সবাই নিয়ম মেনে চলে, তাহলে একদিন জ্যামমুক্ত, শৃঙ্খলাপূর্ণ, স্মার্ট ঢাকা হয়ে উঠবে বাস্তব। কারণ, ট্রাফিক সিগন্যালের আলো শুধু রাস্তা নয়, জাগিয়ে তোলে নাগরিক সচেতনতার আলোও।

সংক্ষিপ্ত বার্তা:
আধুনিক নগর মানে শুধু উঁচু ভবন নয়, নিয়ম মেনে চলা নাগরিক। সিগন্যালের লাল, হলুদ, সবুজ এই তিন রঙেই লুকিয়ে আছে আমাদের শহরের ভবিষ্যৎ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও