বেকারত্ব ঠেকাতে রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে

অক্টোবর ১১ ২০২৫, ১৩:২৩

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো শিল্প খাত। গার্মেন্টস, কলকারখানা, ওষুধ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, চামড়া, ইলেকট্রনিকস প্রতিটি খাতই দেশের রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সক্ষমতার প্রাণ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন অভিযোগে একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে হাজার হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা ও পরিবার বিপন্ন অবস্থায় পড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান অবৈধ কার্যক্রমে জড়িত থাকলে বা মালিক অপরাধে অভিযুক্ত হলে তার বিচার অবশ্যই হবে, কিন্তু সেই কারণে পুরো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে সেটি অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ। কারণ, একটি কলকারখানা বন্ধ মানেই কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার শ্রমিকের জীবিকা থেমে যাওয়া। আর এটাই পরোক্ষভাবে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান উৎসে পরিণত হচ্ছে।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু গার্মেন্টস ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা এসেছে। কোনটি কর ফাঁকি, কোনটি পরিবেশ দূষণ, আবার কোনটি মালিকপক্ষের দুর্নীতির অভিযোগে।

কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, প্রতিটি বন্ধ প্রতিষ্ঠানের পেছনে হাজার হাজার শ্রমিকের কান্না জমে আছে। তারা হয়তো কোনদিনই অপরাধে জড়ায়নি; তবু তারা বেকার, অনিশ্চিত ও হতাশ।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে একজন নারী শ্রমিক বলেন, আমরা দোষ করিনি, কিন্তু মালিকের কারণে এখন কাজ নেই। ঘরে তিন সন্তান, কিভাবে খাব?

এটাই দেশের প্রকৃত বাস্তবতা। মালিকের অপরাধে শ্রমিকের শাস্তি এই অবিচারই সমাজে তৈরি করছে অসন্তোষ, অরাজকতা ও অপরাধপ্রবণতা।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো ব্যক্তি বা মালিক যদি বেআইনি কার্যকলাপে জড়িত থাকে, তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটিকে চালু রাখার জন্য প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো আলাদা করে দেওয়া যেতে পারে, যাতে উৎপাদন অব্যাহত থাকে, শ্রমিকদের জীবিকা বজায় থাকে, আর অর্থনৈতিক চাকা ঘুরে চলতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শিল্প প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়া মানে একটি অর্থনৈতিক প্রাণরস বন্ধ করে দেওয়া। মালিককে আইনের আওতায় আনুন, কিন্তু উৎপাদন চলুক।’

তিনি আরও যোগ করেন, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত কর্মসংস্থান রক্ষা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, শাস্তি নয় সংস্কার।

বাংলাদেশে এখন প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন বেকার। এই বেকারত্ব যখন শিল্প বন্ধের কারণে আরও বাড়ছে, তখন এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সামাজিক নিরাপত্তার ওপর। বেকার মানুষ কাজ না পেলে হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয়, এবং সহজেই পড়ে অপরাধ চক্রের হাতে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত অনেক চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, এমনকি মাদক ব্যবসায়ও যুক্ত হয়েছে হঠাৎ বেকার হয়ে পড়া তরুণরা।

অপরাধবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কর্মহীনতা মানুষকে করে তোলে ‘অনৈতিক সুযোগের’ দিকে আকৃষ্ট। অতএব, শিল্প বন্ধ হওয়া মানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং সামাজিক সংকট ও অপরাধ বৃদ্ধির শেকড়।

শিল্প শুধু উৎপাদনের জায়গা নয়; এটি একটি মানবিক ব্যবস্থা। এখানে শ্রমিক, কর্মকর্তা, সরবরাহকারী, ট্রান্সপোর্ট কর্মী, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স সবই সংযুক্ত। একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে কেবল শ্রমিক নয়, পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলই ধসে পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে সেই ফ্যাক্টরির কাপড় সরবরাহকারী, সুতার দোকানদার, ট্রান্সপোর্ট কর্মী, এমনকি ক্যান্টিনের রান্নার শ্রমিকও কর্মহীন হয়। অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ মানে অন্তত ৫০০–১০০০ পরিবারের আর্থিক শূন্যতা।

এক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যদি কোনো মালিক কর ফাঁকি দেয়, বা দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়, তবে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ব্যাংক হিসাব, বা মালিকানা অংশ জব্দ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় স্বার্থে চালু রাখা জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে সেগেুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাদের মতে, মালিককে আইনের আওতায় এনে প্রশাসক নিয়োগ করা। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ না রেখে। সরকার নিযুক্ত প্রশাসকের মাধ্যমে উৎপাদন সচল রাখা। অবৈধ অর্থ বা অনিয়ম প্রমাণ হলে জরিমানা করা। প্রমাণিত অপরাধের ক্ষেত্রে মালিককে জরিমানা বা শাস্তি দেওয়া হোক কিন্তু শ্রমিকের রুটি-রুজি বন্ধ করা নয়। কোনো তদন্ত চলাকালীন সময়েও শ্রমিক যেন বেতন থেকে বঞ্চিত না হয়। বিনিয়োগকারীরা যেন ভয় না পায় যে, ‘একটি মামলা মানেই শিল্প বন্ধ’।

বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ইতিমধ্যে উদ্বেগজনক। বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয় এটি সমাজের অস্থিরতা, অপরাধ, পারিবারিক ভাঙন ও নৈতিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়। একজন বেকার মানুষ যখন সংসারে অবহেলিত হয়, তখন সে হয় হতাশ, হয় মাদকাসক্ত, বা সমাজবিরোধী।

এমন পরিস্থিতিতে যদি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হয়, তাহলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে। অতএব, সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত শিল্পকে বাঁচানো, কর্মকে বাঁচানো।

দেশের সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও শ্রমিকনেতারা সবাই একই কণ্ঠে বলেছেন, শিল্প বন্ধ মানে জাতির ভবিষ্যৎ বন্ধ।

শিক্ষাবিদ ড. নাসরিন আরা বলেন, একটি কলকারখানা চালু থাকা মানে একটি এলাকার অর্থনৈতিক প্রাণ সচল থাকা। মালিক অপরাধ করলে তাকে সাজা দিন, কিন্তু শ্রমিকের পেটে লাথি মারবেন না।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানও একই মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে অপরাধ দমন হয় না; বরং সমাজে আরও নতুন অপরাধ জন্ম নেয়।সরকারের নীতি হোক শিল্প টিকিয়ে রেখে শাস্তি দিন।

সরকার ইতোমধ্যে কয়েকটি বন্ধ কলকারখানা পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সময় এসেছে একটি জাতীয় শিল্প রক্ষা নীতি প্রণয়নের, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে, “কোনো ব্যক্তি অপরাধে অভিযুক্ত হলেও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যাবে না; প্রয়োজনে সরকারি প্রশাসক বা অংশীদারিত্ব মডেলে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে।”

এটি শুধু অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করবে না, বরং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে।

কারণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও দেখতে চায় বাংলাদেশে শিল্পের স্থিতিশীলতা আছে, হঠাৎ কোনো ঘটনায় পুরো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় না।

শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার চাইলে বন্ধ মিল-কলকারখানা পুনরায় চালু করতে পারে। তাদের মতে, বন্ধ কলকারখানা চালু করতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে।

বন্ধ মিল ও কারখানাগুলো পুনর্মূল্যায়ন: কোনগুলো সামান্য মূলধন বা ব্যবস্থাপনা সংস্কারে চালু করা সম্ভব, তা চিহ্নিত করা।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: বন্ধ কারখানা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সাথে যৌথভাবে চালু করা যেতে পারে।

শ্রমিক সহায়তা তহবিল: বন্ধ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা যেতে পারে।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা: যারা বন্ধ কারখানা অধিগ্রহণ করে পুনরায় চালাতে চান, তাদের জন্য কর রেয়াত ও সহজ ঋণ সুবিধা দেওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, আজ যদি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকে, তাহলে দেশে উৎপাদন বাড়বে, রপ্তানি বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, আর অপরাধ কমবে। শিল্প মানে কেবল অর্থ নয় এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও মর্যাদার প্রতীক। একজন শ্রমিকের হাসি মানেই রাষ্ট্রের স্থিরতা। আর শিল্প প্রতিষ্ঠানই সেই হাসির উৎস।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও