শ্রমের হাটে ভিড়, কাজের জন্য অপেক্ষা

নভেম্বর ১৯ ২০২২, ০০:৫০

ডেস্ক প্রতিবেদক ‍॥ মানুষ কেনা-বেচার হাটেও দীর্ঘশ্বাস। মানুষ আছে, কিন্তু কেনা-বেচা বলতে নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফিরে যাচ্ছেন তারা। শূন্য হাতে ঘরে ফিরে কি করবে? চিন্তার ভাঁজ তাদের কপালে। রাজধানীর শ্রমবাজারের এ চিত্রই বলে দিচ্ছে দিনমজুরেরা ভালো নেই। তারপরও প্রতিদিনই শ্রম বিক্রির হাটে ভিড় বাড়ছে। এক সময় তাদের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে চাহিদা একেবারে তলানিতে। দৈন্যতায় জর্জরিত মানুষগুলো এই হাটে আসেন। শ্রম বেঁচে ৫০০-৬০০ টাকা রোজ হিসেবে পাবেন এ আশায়। কিন্তু প্রতিদিনই শ্রমিকদের বড় একটা অংশই কাজ পান না।

মলিন মুখে বাড়ি ফেরেন। এতে তাদের দুঃখ, দুর্দশা কেবল বাড়ছে। সংসার চালাতে ফাঁদে পড়ছে সুদের কারবারিদের। দিন দিন বাড়ছে ঋণের বোঝা। খেয়ে না খেয়ে জীবন চলছে তাদের। রাজধানীর গাবতলী, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন স্পটে এমন মানুষ বিক্রির হাট বসে। কোনো হাটে শতাধিক, কোনো হাটে দুই শতাধিক শ্রমিক জড়ো হন। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিজেদের বিক্রি করেন। ওই সময় পর্যন্ত শ্রম দিয়ে অর্জন করেন টাকা। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন এক-তৃতীয়াংশ কিংবা তারও বেশি শ্রমিক অবিক্রীতই থেকে যান। বাড্ডা মানুষ বেচার হাটে শ্রমিক ফোরকান হোসেন বলেন, কাজের অবস্থা বেহাল। ৪-৫ দিন ধরে কোনো কাজ পাইলাম না। পরিবার তো না খাইয়া মরবো। সকাল ৬টায় আসি, বেলা ১২টা পর্যন্ত থাকি। কাজ পেলে নিজেকে সঁপে দেই। না পেলে নিরাশ হয়ে ফিরে যাই।

জীবিকার খোঁজে ফোরকান ঢাকা এসেছেন ২০ বছর আগে। থাকেন বাড্ডা এলাকায়। তখন থেকেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি জানান, আগে তার কষ্টের পারদ এত ভারী ছিল না। গত ৩ বছর ধরে কষ্টকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন। শ্রমের হাটে বিক্রি হলে রোজ ৫০০-৬০০ টাকা পান। কিন্তু প্রতিদিন কাজ পান না তিনি। এতে মাসে সর্বোচ্চ ৮-১০ হাজার টাকা আয় হয়। এরমধ্যে ৪ হাজার টাকা প্রতি মাসে ঘর ভাড়া দেন। বাকি টাকা দিয়েই তার সংসারের যাবতীয় খরচ মেটাতে হয়। কিন্তু বর্তমানে সেই চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। এতে বড় হচ্ছে বাকির খাতা। ফোরকান বলেন, দোকানে বাকি আছে। ঘর ভাড়া ১১ হাজার টাকা পাইবো। বাড়িওয়ালা চাপ দেয়। আমাদের তো কাজ নাই। কীভাবে দিবো। ফার্মেসিতে টাকা পাইবো।

ছেলে মাদ্রাসায় যায় সেখানে বেতন বাকি পড়ে আছে। ধার আনছি সেই টাকা পাইবো। সবমিলে ২০ হাজার টাকা ঋণ আছে। আগে ৪০০ টাকা রোজ হিসেবে কাজ করলেও সংসার চলতো। কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারতাম। এখন উল্টো চিত্র। ফোরকান বলেন, আমরা যখন ঢাকা আসছি তখন গরুর মাংস ছিল ৪০০ টাকা কেজি। এখন ৭০০ টাকা কেজি। চাল ছিল ১০ টাকা কেজি। এখন ৮০ টাকা কেজি। এখন এক হাজার টাকার কাজ করলেও চলা যায় না। কাজ একদিন হইলে পাঁচদিন হয় না।

শ্রমের হাটে রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রঙ মিস্ত্রি, স্যানিটারি মিস্ত্রি, দিনমজুরসহ নানা পেশার শ্রমজীবীরা বসে আছেন। অন্য কোনো আয়ের পথ না পেয়ে এখানে আসেন তারা। মাসুদ মাতবর তাদের একজন। তার স্ত্রী ও চার মেয়েসহ ৬ জনের বড় পরিবার। কর্তা তিনি একাই। একটি ঘরের মধ্যেই সবাই একসঙ্গে বাস করেন। ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিলও আলাদা দিতে হয়। দুই রুমের বাসা নেয়ারও জো নেই। মাসুদ বলেন, প্রতিদিন এখানে এসে বসে থাকি। মাঝেমধ্যে কাজ পাই। মাসে ৭-৮ হাজার টাকা হয়। গ্রাম থেকে দুই-তিন মাস পর এক-দেড় মণ চাল নিয়া আসি। যে বাজার খরচ হয় তা কাজের টাকা দিয়া হয় না। এক বেলা খাই আবার না খেয়েও থাকা লাগে। কাজ না থাকলে কীভাবে খাবো। বাড্ডা শ্রমের হাটের সুমন বলেন, দিনকাল খারাপ যাচ্ছে। কাজ নাই। পরিবার নিয়ে থাকা কষ্ট হচ্ছে। মাসে অল্প কয়দিন কাম পাই। ধার করে চলতে হয়। সুদের টাকায় চলি। ১০ হাজার টাকা সুদে লোন নিয়েছি। প্রতিমাসে ৫০০ টাকা সুদ দেয়া লাগে। আসল তো থেকেই যায়। নারী হওয়ায় পারিশ্রমিক কম পান বলে দাবি করেন ষাটোর্ধ্ব সুফলা বেগম। এতে তার ক্ষোভও রয়েছে। পরিবারে কোনো পুরুষ মানুষ না থাকায় বাধ্য হয়েই তাকে শ্রমের হাটে দাঁড়াতে হয়। ভোর থেকে অপেক্ষা করেন তিনিও। সুফলা বলেন, ছেলে মানুষ যেখানে ৬০০ টাকা মজুরি পায় আর আমাদেরকে দেয়া হয় ৫০০ টাকা। সাড়ে ৫০০ টাকা চাইলে বলে তুই বেশি টাকা চাস। তোরে কাজে নিবো না।

প্রতিদিন কাজও থাকে না জানিয়ে তিনি বলেন, আগের চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মাসে ১৫ দিনও কাজ করতে পারি না। নেত্রকোনা থেকে মাঝে মধ্যেই কাজের খোঁজে ঢাকার আগারগাঁও শ্রমের হাটে আসেন মো. মানিক। তিনি জানান, নেত্রকোনায় তেমন কাজ পাওয়া যায় না। এজন্য মাঝে মধ্যেই ঢাকা আসি। এখানে ৬০০ টাকা মজুরি পাই। মাঝে মধ্যে কম মজুরিতেও যাওয়া লাগে। তাছাড়া উপায় থাকে না। তিনি বলেন, প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না।

অনেক সময় একদিন কাজ করলে তিন দিন বসে থাকা লাগে। আগের চেয়ে এখানে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। কাজ পেতেও প্রতিযোগিতা শুরু হয়। জিনিসের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় কষ্টের কথা জানিয়ে মানিক বলেন, বড় সংসার। এরমধ্যে শুধু আমিই কাজ করি। জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিশোরগঞ্জের রুবেল হোসেন বলেন, কাজ অনেক কমে গেছে। একদিন কাজ পেলে ৪ দিন বসে থাকা লাগে।

মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন যদি কাজ থাকতো তাহলে কিছুটা হলেও শান্তিতে থাকতাম। তিনি বলেন, জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন সংসার চালাতে আরও কষ্ট হচ্ছে। কোনো রকম ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও