বাংলাদেশকে ঋণ দিতে আইএমএফ’র সম্মতি, ৫ পরামর্শ

নভেম্বর ১০ ২০২২, ০৮:৩৭

অনলাইন ডেস্ক: অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে যাচ্ছি। আইএমএফ’র কাছ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে প্রাথমিক সম্মতি পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ফেব্রুয়ারিতেই এ ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে।
সচিবালয়ে গতকাল সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান অর্থমন্ত্রী। এ সময়  উপস্থিত ছিলেন- গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও অর্থসচিব ফাতেমা ইয়াসমিন। এদিকে একই দিনে আরেক সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফ’র তরফ থেকে জানানো হয়, ঋণের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে স্টাফ লেভেলে সমঝোতা হয়েছে।
একে ওই ঋণের ব্যাপারে আইএমএফ’র সবুজ সংকেত বলা যেতে পারে। আইএমএফ’র সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রধান পাঁচটি বিষয়ে সংস্কারে সম্মত হয়েছে সরকার। এগুলো হলো- বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জায়গা তৈরি করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন, আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণ, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা।

কীভাবে ঋণ দেয়া হবে:

আইএমএফ’র এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ঋণসহায়তা করার বিষয়ে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা হয়েছে।

৪২ মাস বা সাড়ে ৩ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে এই ঋণ ছাড় করা হবে। অর্থাৎ পুরো ঋণটি পেতে ২০২৬ হয়ে যাবে।

এর মধ্যে বর্ধিত ঋণ-সুবিধা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সুবিধার (ইএফএফ) আওতায় ৩২০ কোটি ডলার আর রেজিলিয়েন্স সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হবে। এই ঋণের মূল উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সুরক্ষা, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের চাপ সামলানো আর জলবায়ু সুরক্ষা তহবিলে সহায়তা করা। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা দিতে কাঠামোগত পরিবর্তনেও জোর দেয়া হয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধিদল জানিয়েছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর ঋণের বিষয়ে পর্ষদের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যাবে। গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জানান, বাংলাদেশে ঋণ দেয়া নিয়ে আইএমএফ’র কোনো উদ্বেগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের উন্নয়ন অংশীদারিত্ব দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেও এই সম্পর্কে কোনো সমস্যা হবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনো ব্যর্থ হয়নি। আইএমএফ’র সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক দীর্ঘ এবং অত্যন্ত ভালো। এছাড়া আমরা শুধু অর্থনৈতিক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করি। রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করি না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো পর্যবেক্ষণ নেই।প্রতিনিধিদলের দলনেতা রাহুল আনন্দ আরও বলেন, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। আইএমএফ প্রতিনিধিদল জানায়, মহামারি কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ জোর কদমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়। এতে একদিকে চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তে থাকে, অন্যদিকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। একই সঙ্গে, মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পায় এবং প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়।

যেসব পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ: 

প্রথম; রাজস্ব বাড়ানো এবং যৌক্তিক ব্যয় ব্যবস্থা চালু করা। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। যারা নাজুক অবস্থায় থাকবে, সেসব খাত লক্ষ করে সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেয়া।  দ্বিতীয়; মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক মুদ্রানীতি তৈরি করা। সেই সঙ্গে মুদ্রাবিনিময় হার আরও নমনীয় করে তোলা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে আধুনিক মুদ্রানীতি। তৃতীয়; আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করা, নজরদারি বাড়ানো, সরকার ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা। চতুর্থ; বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পরিবেশে তৈরি, মানব দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা। পঞ্চম; জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা, পরিবেশের উন্নতির পদক্ষেপ নেয়া এবং জলবায়ু সংক্রান্ত খাতে আরও বিনিয়োগ ও আর্থিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

আইএমএফ’র এই সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, যেমন রেভিনিউ বাড়ানো, সরকারও অনেকদিন ধরেই এসব নিয়ে কাজ করছে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করার মতো শর্ত-এ নিয়ে আমরা অনেকগুলো মিটিং করেছি। তাদের শর্ত আমাদের শর্ত একই হলো। অর্থমন্ত্রী বলেন, অনেকের অনুমান ছিল, আমরা আইএমএফ’র ঋণ পাবো না কিংবা তারা কঠিন শর্ত দেবে। তেমন কিছুই হয়নি। তবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য আইএমএফ’র কিছু পরামর্শ আছে। আমরাও সেভাবে কাজ করছি। অর্থমন্ত্রী জানান, এই সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আইএমএফ বাংলাদেশকে দেবে ৭ কিস্তিতে। শেষ কিস্তি বাংলাদেশ হাতে পাবে ২০২৬ সালে। সুদের হার হবে ২.২ শতাংশ। তিনি বলেন, প্রথম কিস্তিতে আসবে ৪৪৮ মিলিয়ন ডলার। এর জন্য বাংলাদেশকে কোনো সুদ দিতে হবে না। পরবর্তী সাত কিস্তিতে বাকি অর্থ আসবে। প্রতি কিস্তিতে অর্থের পরিমাণ হবে ৫৫৯.১৮ মিলিয়ন ডলার।  অর্থমন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্বের অর্থনীতিই এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল সকল দেশে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে।

প্রায় সকল দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমে গিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এ উত্তাপের আঁচ আমাদের অর্থনীতিতেও কিছুটা লেগেছে। এ অস্থিরতা যাতে কোনো ধরনের সংকটে ঘনীভূত না হয়, তা নিশ্চিত করতেই আমরা আগাম সতর্কতা হিসেবে আইএমএফ’র ঋণের জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তাদের সঙ্গে এর আগে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। চলমান ঋণ আলোচনার পর্বটি আমরা সফলভাবে সমাপ্ত করলাম। মন্ত্রী বলেন, আইএমএফ টিম আমাদের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। সে অনুযায়ী আমরা চার বছর মেয়াদি ঋণ কর্মসূচি নিতে যাচ্ছি। মন্ত্রী বলেন, সরকারের বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হবে, যা গত প্রায় ১৪ বছর যাবত আমরা করে আসছি। আমাদের সরকারের সবসময় প্রচেষ্টা থাকে বাজেট ঘাটতিকে জিডিপি’র ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বছর আমাদের বাজেট ঘাটতি ছিল ৫.১ শতাংশ, যা এই অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশ ধরা আছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করা, যা আমরা প্রতি অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছি। অর্থমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সঙ্গে সময়ে সময়ে সমন্বয় করা, যাতে সামনে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমলে দেশের অভ্যন্তরেও তা একইভাবে কমানো যায়।

টাকার বিনিময়হার নির্ধারণের কাজটি ধীরে ধীরে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া, যা আমরা ইতিমধ্যে শুরু করেছি। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা। একটি দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়নের পরিকল্পনা করা, যার মধ্যে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার বিষয়টিও থাকবে ইত্যাদি। চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে ওয়াশিংটনে আইএমএফ’র প্রধান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ সরকার। তারই অংশ হিসেবে ঋণ দেয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করতে আইএমএফ’র দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল গত ২৬শে অক্টোবর ঢাকায় আসেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও