উজিরপুরে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অসন্তোষ!
জানুয়ারি ১৬ ২০২৩, ১৭:৩৬
বিএম রবিউল ইসলাম, উজিরপুর ॥ বরিশালের উজিরপুরে তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। এগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য প্রজ্জনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে প্রসূতি মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো। এই কাজে বেশ সাফল্য পেয়ে আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃতও হয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের মুন্ডপাশা গ্রামের মুন্ড পাশা কমিউনিটি ক্লিনিকে সরেজমিন অনুসন্ধানে মিলেছে করুণ চিত্র।
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল ও সরকারি কর্মীদের নীতি-নৈতিকতার অভাবে জনগণের টাকায় নির্মিত ও পরিচালিত ক্লিনিকগুলো একরকম অকেজো অবস্থায় রয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন সহায়তায় উপজেলা পর্যায়ের প্রথম সারির সুপারভাইজার প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা’ (প্রথম মুদ্রণ জুন ২০১৯, পুনর্মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০২২) প্রকাশ করে। ১৫০ পৃষ্ঠার নির্দেশিকার ৩৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে—‘কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩৪ ধরনের সেবা প্রদান করা হবে।’ প্রথমেই উল্লেখ রয়েছে—‘সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসবপূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ), প্রসবকালীন এবং প্রসব-উত্তর (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা’।
কিন্তু বাস্তবে এখানে মুন্ড পাশা কমিউনিটি ক্লিনিকে এসব সেবার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এ ছাড়া ৩৬ পৃষ্ঠায় বাড়িকেন্দ্রিক সেবার ক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘অন্তঃসত্ত্বা মহিলা যেন প্রসব-পূর্ব সেবা নিতে (প্রতিষেধক টিকাসহ) ক্লিনিকে আসে, তার জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করা।’
এ ছাড়া আছে, ‘অপারগ ও অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর দূরবর্তী এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে সেবাপ্রদান। প্রতি ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন করেন তিনজন কর্মী—একজন সিএইচসিপি (কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইটার), একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার কল্যাণ সহায়ক।
সর্বনিম্ন হিসাব অনুয়ায়ী মাসে একটি ক্লিনিকে সরকারকে তিনজনের বেতন-ভাতা বাবদ পরিশোধ করতে হয় ৪৭ হাজার ৬৭০ টাকা। প্রতিটি ক্লিনিকে অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিনসহ ২৭ গ্রুপের ওষুধ দেওয়া হয়।
স্বাভাবিক নিয়মে বছরে চার মাস পর পর প্রতিটি ক্লিনিকে দুটি করে ছয়টি কিট বা বক্স দেওয়া হয়। প্রতি বক্সে ২৬ হাজার ২৫৯ টাকার ওষুধ থাকে। কোনো ক্লিনিক ওষুধের চাহিদা এর চেয়ে বেশি দেখালে বাড়তিও দেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে।
রেজিস্টার খাতায় রোগীর ছড়াছড়ি!
অথচ ওই কমিউনিটি ক্লিনিকের রেজিস্টার খাতা ভর্তি রোগীর নাম। শিকারপুর ইউনিয়নের
মুন্ড পাশা কমিউনিটি ক্লিনিকের রেজিস্টার খাতায় দেখা যায়, ২ হাজার ২২ সালের ডিসেম্বর মাসে চারশত ১৫ জন রোগী এবং ২ হাজার ২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত ২৫০ জন রোগী সেবা দিয়েছেন।
কিন্তু ক্লিনিকগুলোর রেজিস্টার খাতায় রোগীর শুধু নাম লেখা থাকে, ঠিকানা বা অন্য কোনো তথ্য থাকে না। তাই যাদের নাম লেখা আছে, তারা আসলেই কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা পেয়েছেন কি না—সেই বক্তব্য নেওয়ার জন্য কোনো রোগীকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে ক্লিনিকের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলেন, ‘শুধু নামই লিখে রাখি আমরা।
শেষ নেই অভিযোগের
গত ১২ জানুয়ারি সকাল ১০টা ২০ মিনিটে শিকারপুর ইউনিয়নের মুন্ড পাশা কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনের চিত্র। ক্লিনিকটি খোলা হয়েছে খানিক আগে। ভেতরে বসে আছেন স্বাস্থ্য সহকারী নিমিতা সেন গুপ্ত। রোগী বলে কেউ নেই। আধাঘণ্টা পর তিনজন রোগী এসে ঢোকেন। একজন রেনু বেগম, আরেকজন আছমা বেগম। তৃতীয়জন মাজিয়া বেগম তাঁর তিন মাসের শিশুপুত্রকে ডাক্তার দেখাতে এনেছেন।
কিন্তু তাঁদের সেবা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রভাইডার বা সিএইচসিপি সাহাদাত তখনো আসেননি। তাঁর জন্য প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে পরে রোগীরা স্বাস্থ্য সহকারী কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। আমরা বসে রইলাম সিএইচসিপির জন্য, এক পর্যায়ে তাঁর দুই সহকর্মীর মাধ্যমে তাঁকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি দুপুর ১২টা ৯ মিনিটে জানালেন তার বাবা অসুস্থ তিনি মৌখিক ছুটি নিয়ে চলে গেছেন।
কিন্তু স্থানীয় একাধিক রোগীরা জানান সিএইচসিপি সাহাদাত তিনি দীর্ঘ ১১ বছর ধরে সকাল ১১টার আগে কখনোই আসেন নাই। তাকে পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ। সিএইচসিপি সাহাদাত জানান,আমি মৌখিক ছুটি নিয়ে গিয়েছি ক্লিনিক তো বন্ধ রাখিনি । তাকা প্রায় দেরি হওয়া প্রসঙ্গে বললেন, ‘একটু কাজে গিয়েছিলাম। দেরি হওয়ার বিষয়টি সহকর্মীদের বলে গেছি।’ অথচ অপেক্ষার এক ফাঁকে,
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শওকত আলিকে ফোন করে জানতে চাইলে তিনি বলেন,সিএইচসিপি সাহাদাকে ছুটি দেয়া হয়নি।
গোপন সূত্রে জানা যায়, সিএইসিপি সাহাদাত নিজ বাড়ির সামনে তার একটি ফার্মেসি আছে। ফার্মেসিতে ক্লিনিকের ভিটামিন ‘এ’সহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি ওষুধ পড়ে আছে। ‘এসব ওষুধ কি তার ফার্মেসিতে বসে রোগীদের বিনা মূল্যে বিতরণ করেন?’ প্রশ্ন করলে সাহাদাত বলেন, ‘হ্যাঁ বা না কিছুই বলেন না। কিছু না লেখার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে তিনি সংবাদ কর্মীর কাছে ফোন দেন। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা পর্যন্ত সেখানে থাকলেও আর কোনো রোগীর দেখা পাওয়া গেল না।
রাস্তায় পড়ে থাকে সরকারি ওষুধ
গত ৯ জানুয়ারি শিকারপুর ইউনিয়নের হাজি বাড়ি সামনে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্যাকেট বন্দি অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওষুধগুলোর পাতায় পাতায় ‘এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লি., ঢাকা লেখা।’ দায়িত্বশীলরা বলেন মুন্ডপাশা কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা সিএইচসিপি সাহাদাত বলেন, ‘আমি একটু দেরি করেই আসি। সপ্তাহে দুই দিন মিটিংয়ে থাকতে হয়। তখন তো আমার কাজ অন্য কেউ করতে পারবে না। এ কারণে কেউ অভিযোগ করতে পারে।’আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।








































