জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় সতর্ক পুলিশ
ডিসেম্বর ২০ ২০২২, ১১:৩৭
অনলাইন ডেস্ক : কদিন পরই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। এ দিনটিকে কেন্দ্র করে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় স্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনায় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছে পুলিশ। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত জঙ্গিরা এই হামলা চালাতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যেসব খ্রিষ্টান মিশনারিতে ধর্মান্তরের প্রক্রিয়া আছে, সেগুলোকে জঙ্গিরা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইতিমধ্যে জঙ্গি সদস্যরা টার্গেটকৃত স্থাপনার আশপাশে অবস্থানও করছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (গোপনীয়) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহীল বাকী স্বাক্ষরিত একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জঙ্গি হামলার এই আশঙ্কা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে হামলার আশঙ্কার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও প্রতিরোধের জন্য করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলা হয়েছে। পুলিশের সব ইউনিটসহ দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছেও এই প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশের জঙ্গি প্রতিরোধে বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে বড়দিনকে কেন্দ্র করে হামলার আশঙ্কা নেই। নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারির অংশ হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তর একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সব সময় জঙ্গিরা যেসব স্থাপনায় হামলা করতে পারে, সেসব স্থাপনায় আমাদের নজরদারি থাকে। আমরা বড়দিনকে কেন্দ্র করেও নিরাপত্তা জোরদার করেছি।’
গত ২০ নভেম্বর পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আনসার আল ইসলামের দুই সদস্যকে ছিনিয়ে নেয়ার পর জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। আনসার আল ইসলাম নিজেদের আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সদস্য মনে করে। কয়েক বছর ধরে জঙ্গিরা কোনো আক্রমণ বা হামলা না করলেও ভেতরে ভেতরে তারা যে সংগঠিত হচ্ছিল, দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নিয়ে তারা তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।
অবশ্য সিটিটিসি কর্মকর্তারাও বলছিলেন, হামলা না করলেও জঙ্গিরা ভেতরে ভেতরে যে সংগঠিত হচ্ছে এই তথ্য তাদের কাছেও রয়েছে। কয়েক বছর ধরে তারা অসংখ্য লোকজনকে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে। কথিত হিজরতের নামে ঘরও ছেড়েছে অনেক তরুণ। সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে একযোগে সাত তরুণ কথিত হিজরতের নামে ঘর ছাড়ার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে।
‘বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থাপনায় সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ শিরোনামে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সম্প্রতি পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে- সিলেটের পাহাড়ি এলাকা এবং কিশোরগঞ্জের আশপাশে একটি খ্রিষ্টান মিশনারি স্থাপনায় হামলা করার সম্ভাব্য হুমকি রয়েছে। ইতিমধ্যে আল-কায়েদার অনুসারী হরকাত-উল-জিহাদের সদস্যদের সঙ্গে জড়িত সমর্থকদের দ্বারা গোপনে প্রাক-অপারেশনাল নজরদারি করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাক-অপারেশনাল নজরদারিকে সহজ ভাষায় রেকি করা বলে। জঙ্গিরা যেকোনো হামলার আগে একাধিকবার টার্গেটকৃত স্থান রেকি করে। বিভিন্ন জঙ্গি হামলার প্যাটার্ন বা গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা এসব তথ্য জানতে পেরেছেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জঙ্গিদের টার্গেটকৃত মিশনারি স্থাপনাটি একটি বড় ছয়তলাবিশিষ্ট সাদা দালান। সেটি সাদা পোশাক পরিধানকারী সাদা লোকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। মিশনারিটি নিঃস্ব, মূলত মুসলিম ধর্ম অনুসারী শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সহায়তা করে এবং যদি কোনো ব্যক্তি খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় তাকে মিশন থেকে খাবার, আশ্রয় এবং কর্মসংস্থানের সহায়তা করে।
‘আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত একদল লোক স্থাপনাটির আশপাশে, এমনকি অভ্যন্তরে অবস্থান করছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং যেকোনো সময়ে হামলার পরিকল্পনা করছে। প্রথমে ছুরির সাহায্যে হামলার পরিকল্পনা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে তা শক্তিশালী হামলার দিকে যেতে পারে’ বলে উল্লেখ করা হয় ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
কিশোরগঞ্জের জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, জেলার সবগুলো মিশনারি ও মন্দির এলাকায় বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। জেলা পুলিশের ১৩২টি বিটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে নিজ নিজ এলাকায় নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেকোনো আগন্তুক বা কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স করা হচ্ছে। পুলিশ যেকোনো ঘটনা মোকাবিলা বা ঠেকানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লিখিত হরকাতুল জিহাদ ও সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে আলোচনায় আসা আনসার আল ইসলাম- নিষিদ্ধ দুটি জঙ্গি সংগঠনই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার মতাদর্শের অনুসারী। হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী, বাংলাদেশ, সংক্ষেপে হুজিবির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছাড়াও একাধিক গির্জাতেও হামলার অভিযোগ রয়েছে। আর আনসার আল ইসলাম, আগে যারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি হিসেবে পরিচিত ছিল, তারা ২০১৩ সাল থেকে টার্গেটেড কিলিং শুরু করে। তাদের টার্গেট ছিল ব্লগার ও প্রকাশক এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। ২০১৭ সালের পর থেকে এই সংগঠনটিকে আর হামলা করতে দেখা যায়নি।
হরকাতুল জিহাদ ও আনসার আল ইসলামের সদস্যরা যৌথভাবে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনও গঠন করেছে। নতুন এই সংগঠনের নির্দেশনায় সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ৭০ তরুণ পার্বত্য এলাকার পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে ঘর ছেড়েছে বলেও জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত দুই মাসে এই সংগঠনের একাধিক মধ্যম সারির নেতাকেও গ্রেপ্তার করেছে এলিট ফোর্স র্যাব ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
হামলা ঠেকানোর সুপারিশ
জঙ্গি হামলার আশঙ্কার পাশাপাশি তা ঠেকানোর জন্যও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো চিঠিতে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, আক্রমণের সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা এবং প্রয়োজনীয় নজরদারি বৃদ্ধি করে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি যেসব মিশনারি বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের চলাচল সীমিত ও নিরাপত্তা প্রদান করা, মিশনারিতে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের চলাচলের রুট বা তাদের মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করা, বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত সব বিদেশির তালিকা তৈরি করা ও তাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে চিঠিতে। এ ছাড়া গির্জা, মিশনারিতে অবস্থানরত সংবেদনশীল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা, সাদা পোশাকে প্যাট্রলিং ব্যবস্থা জোরদার করাসহ আশপাশের সব এলাকায় ব্লকরেইড কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি পুলিশ চেকপোস্টগুলোতে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে সেগুলোকে বেশি পরিমাণে কার্যকর করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী বিভিন্ন মামলার আসামিরা জামিন পাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করে। জামিনপ্রাপ্ত সবার তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিস্ট এলাকায় পাঠিয়ে স্থানীয় পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তাদের অবস্থান সার্বক্ষণিক মনিটর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী মামলার আসামিরা যেসব জেলখানায় অবস্থান করে, সেসব স্থানের অভ্যন্তরীণ নজরদারি প্রয়োজনীয় পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। জেলখানাগুলোর অভ্যন্তরে থেকে বিভিন্ন মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বা অন্য উপায়ে বাইরে অবস্থানকারী অন্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাশকতার কোনো পরিকল্পনা করতে না পারে। একই সঙ্গে এসব আসামির সঙ্গে যারা দর্শনার্থী হিসেবে দেখা করতে আসেন, তাদের পরিচিতি লিপিবদ্ধ করে সাক্ষাতের সময় নজরদারি বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হয়েছে। সূত্র: দৈনিক বাংলা








































