হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বিজয়

ডিসেম্বর ১৬ ২০২২, ১২:১৯

ডেস্ক প্রতিবেদক: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি যে বিজয় অর্জন করেছিল বাঙালির ইতিহাসে এই বিজয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়। এই বিজয় আজ থেকে হাজার বছর পরেও বাঙালি স্মরণ করবে। কারণ, এর আগে যেসব বিজয় সেসব বিজয় ছিল কোনো নৃপতির বা কোনো ঔপনিবেশিক শক্তির, জনগণের নয়, সাধারণ মানুষের নয়। বিশ্ব ইতিহাসে নৃপতিদের থেকে, সেনাপতিদের থেকে, সামন্তদের আধিপত্য থেকে জনগণের অধিকার-পাওয়ার যেসব সংগ্রাম তা-ই ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

এসব সংগ্রামের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ইংল্যান্ডের রাজার সার্বভৌম ক্ষমতাকে (অনংড়ষঁঃব ঢ়ড়বিৎ) খর্ব করে জনগণের জন্য যে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই সংগ্রাম। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আমেরিকার ১৩টি কলোনি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল ছিন্ন করে যে বিজয় অর্জন করেছিল, সে বিজয়।

১৭৮৯ সালে ফরাসি জনগণ ফরাসি স¤্রাটের এবং তার সামন্তদের নিরঙ্কুশ শাসনের বন্ধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে জনগণের যে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই বিজয়। ফরাসি বিপ্লবের এই বিজয়ের মাধ্যমেই বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম সাধারণ মানুষের মানবাধিকারের যে ঘোষণা আসে, সেই ঘোষণা এসেছিল ১৭৮৯ সালের ৪ আগস্ট, ‘ডিক্লারেশন অফ দি রাইটস অফ ম্যান’-‘Declaration of the Rights of man’। ঘোষণা হয়েছিল, ‘আজ থেকে ফ্রান্সের সব মানুষ স্বাধীন, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির ‘স্বাধীনতার’ যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারই বিজয় পতাকা উড্ডীন হয় ১৬ ডিসেম্বর।

এই বিজয়ের মাধ্যমেই বাঙালি তার প্রথম রাষ্ট্র, নিজের রাষ্ট্র অর্জন করে। এরই সাংবিধানিক ঘোষণা আসে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের, বাঙালির প্রথম সংবিধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গণপরিষদে উপস্থাপন ও গ্রহণের মাধ্যমে। এই সংবিধানেই ঘোষণা করা হয় ‘বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’।
॥ ২ ॥
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ২৩ বছরব্যাপী পূর্ব পাকিস্তানকে নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিকভাবে শোষণ করে যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প, কৃষি ও সেবা খাত গড়ে তোলে তারই অবসান হয় নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে। এই সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা যে বিজয় অর্জন করি তার জন্য ত্রিশ লাখ বাঙালি আত্মোৎসর্গ করেছিল; প্রায় তিন লাখ জননী-জায়া-কন্যা আত্মসম্ভ্রম বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।

 

বিশ্ব ইতিহাসে কোনো দেশ স্বাধীনতার জন্য এত বৃহৎ ত্যাগ-স্বীকার করেনি। আলজেরিয়া ও ভিয়েতনাম তাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিশাল মূল্য দিয়েছে, জীবন উৎসর্গ করেছে, কিন্তু সে-আত্মোৎসর্গ বাঙালির আত্মোৎসর্গের মতো এত বিরাট নয়। কারণ, পাকিস্তান বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা ছিল নিরস্ত্র, নিরীহ জনগণের উপর।

 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয় সেই পাকিস্তানের সব মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে এটাই ধারণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অনেক সহকর্মীরা। কিন্তু প্রতিষ্ঠালগ্নেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নভঙ্গ হয়, যখন তিনি দেখলেন পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ জনগণ বাঙালি হলেও এই রাষ্ট্রের রাজধানী থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাহিনী, সৈন্যবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী সবকিছুরই কেন্দ্র হলো পশ্চিম পাকিস্তানে, পূর্ব বাংলাকে রূপান্তরিত করা হলো সব ব্যয়ের বিরাট উৎস হিসেবে, পুঁজির উৎস হিসেবে।

পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীতে প্রায় চার লক্ষাধিক সৈন্য ছিল। সেই সৈন্যবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র বিশ হাজারের সামান্য কিছু বেশি। নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীও বিরাটভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল কিন্তু এসব বাহিনীতেও বাঙালির সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীতে মাত্র একজন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার, একজন বাঙালি কর্নেল ও কয়েকজন (আঙ্গুলে গোণা যায়) মেজর ও ক্যাপ্টেন ছিলেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল, লে. জেনারেল, মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার কর্নেল, লে. কর্নেল ইত্যাদি উচ্চ পদের সব অফিসারই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি মুখ্যত: পাঞ্জাবি। এছাড়া ছিল অসংখ্য পশ্চিম পাকিস্তানি মেজর ও ক্যাপ্টেন। কিন্তু এই সৈন্যবাহিনীর জন্যই বিশাল ব্যয় বহন করতে হতো পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থাৎ বাংলাদেশকে। কারণ, পাকিস্তানের বার্ষিক বাজেটের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই ব্যয় করা হতো সামরিক খাতে।
পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি ছিল ১২৩৭.৪ কোটি টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ১২০৯.১ কোটি টাকা। কিন্তু ১৯৬৯-৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের জিডিপি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৫৬.৩ কোটি টাকায় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে জিডিপি কমে দাঁড়ায় ২২৭১.৩ কোটি টাকায়। এই বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থাৎ বাংলাদেশকে শোষণ করে।

এই শোষণের অবসানের জন্যই, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন; এই দাবিতে প্রকৃতপক্ষে মূর্ত ছিল দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অবয়ব। এই দাবি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র। কারণ, মেনে নিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের জন্য পুঁজির উৎসই হারিয়ে যেত।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি উত্থাপন করলেও বহুকাল আগেই ৫০-এর দশকের মধ্যভাগেই এই শোষণকে চিহ্নিত করেছিলেন এবং তার জন্য দায়ী করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সেসব নেতাদের যারা ক্ষমতা ও বিত্তের লোভে আত্মবিক্রয় করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের কাছে। তিনি লিখেছেন, ‘অন্যদিকে পূর্ব-বাংলার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করেই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করতে লাগল। ফলে একদল শিল্পপতি গড়ে তুলতে শুরু করল, যারা লাগামছাড়া অবস্থায় যত ইচ্ছা মুনাফা আদায় করতে লাগল জনসাধারণের কাছ থেকে এবং রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেল।
করাচি বসে ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট ব্যবসার নাম করে লাইসেন্স বিক্রি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করে আস্তে আস্তে অনেকে শিল্পপতি হয়ে পড়েছেন। এটাও মুসলিম লীগ সরকারের কীর্তি। বাঙালি তথাকথিত নেতারা কেন্দ্রীয় রাজধানী, মিলিটারি হেড কোয়ার্টারগুলো, সমস্ত বড়ো বড়ো সরকারি পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য পাঞ্জাবি ভাইদের হাতে দিয়েও গোলাম মোহাম্মদ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।’
পাকিস্তানি শাসকচক্র প্রকৃতপক্ষে জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিকে কোনো অধিকারই দিতে চায়নি; সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক। ১৯৪৮ সালেই তারা বাঙালিকে তার ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিল, ঘোষণা করেছিল, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, যা বাঙালিরা বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিরোধ করেছিল। ১৯৫৪ সালে তারা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে মাত্র তিন মাসেরও কম সময় ক্ষমতায় থাকতে দিয়েছিল।
॥ ৩ ॥
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তাকে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হলো না; কারণ, বঙ্গবন্ধু বাঙালির যে সার্বিক মুক্তি চেয়েছিলেন তা দিতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ রাজি ছিল না। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ভাষণে, যা ছিল প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব ইতিহাসের স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ ভাষণ (কারণ বিশ্বে আর কোনো নেতা দশ লক্ষ জনতার সামনে এমন কাব্যিক ছন্দে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি) ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই বাক্যটি ছিল মহাকাব্যিক।

কারণ, এই বাক্যে একটি জাতির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন মূর্ত হয়েছিল। আজ আমরা এই ঘোষণার অর্ধশতাব্দী দূরে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করি, বাঙালির আজ যে উত্তরণ ঘটেছে উন্নয়নের স্বর্ণ-সোপানে তা কোনদিনই সম্ভব হতো না যদি না আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন না করতাম।
আজ আমরা কোথা থেকে কোথায় এসেছি তা সহজেই স্পষ্ট হয় যখন আমরা দেখি ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় থেকে সত্তর শতাংশের কম; আজ সেই বাংলাদেশেরই মাথাপিছু আয় থেকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় প্রায় শতাংশ কম। আজ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় যখন ২৮২৪ ডলার, পাকিস্তানের মাত্র ১২৫০ ডলার। বাংলাদেশ তার ১৯৭১-এর বিজয়কে গত দেড় দশকে প্রকৃত বিজয়ে রূপান্তরিত করেছে; বাংলাদেশের দারিদ্রকে সম্পূর্ণ জয় করার যে পথে যাত্রা শুরু করেছে সেই পথে সে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

প্রতিটি মানুষকে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য দেশরত্ন শেখ হাসিনা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, অনাথ, দুস্থ ও নারীদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যে অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছেন, প্রতিটি শিশুকে শিক্ষার আলোয় আলোকদীপ্ত করার যে প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন তা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের যে-বিজয় সেই বিজয়কে যথার্থ অর্থে মহিমাদীপ্ত করছে। আলোর পথে এই পদচারণাকে পূর্ণতা দেওয়ার ভার, ১৯৭১-এর বিজয়কে প্রকৃত বিজয়ে রূপান্তর করার ভার আমাদের তরুণ প্রজন্মকেই নিতে হবে।
আমাদের সংবিধানে যে কথাটি লেখা রয়েছে ‘প্রতিটি মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে হবে’ সেই অঙ্গীকারকে পূর্ণতা দিতে হবে। প্রতিটি শিশু জন্মের সময় যে অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায় তাকেও পূর্ণতা দিতে হবে। তাকে কেবলমাত্র স্বাস্থ্য, শিক্ষার অধিকারই নয়, অর্থবহ কর্মের অধিকারও সংস্কৃতিঋদ্ধ জীবনের অধিকার দিতে হবে। আমরা আশা করি, এই শতাব্দীর অর্ধভাগেই যখন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এসব অধিকার অর্জন করবে তখনই সে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই ‘মুক্তি’ অর্জন করবে; বিজয় অর্জন করবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও