তদবির-বাণিজ্যের হাট বসত দীপু মনির বাসায়
নভেম্বর ২০ ২০২৪, ১৫:৫৪
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: চাঁদপুর-৩ আসনে (সদর-হাইমচর) উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন দীপু মনি। আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছরে দলের মধ্যে করেছেন কয়েক ভাগ। তিনবার মন্ত্রী, একবার এমপি হয়ে নিয়েছেন বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প।
কিন্তু নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা অমিল হওয়ায় এবং লুটপাটের কারণে ওইসব উন্নয়ন প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। তার টাকার মেশিন ছিল ৫ আগস্টে গণপিটুনিতে নিহত আলোচিত বালুখেকো চেয়ারম্যান সেলিম খান। বিশেষ করে দীপু মনি মন্ত্রী থাকাকালে তার বাসায় তদবির-বাণিজ্যের হাট বসাতেন দীপু মনির বড় ভাই ডা. জেআর ওয়াদুদ টিপু।
চাঁদপুরের রাজনীতিতে তৃণমূলে কোনো অবস্থান না থাকলেও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় ২০০৮ সালে চাঁদপুর-৩ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন দীপু মনি। তারপর আর তাকে থেমে থাকতে হয়নি।
দীপু মনি মন্ত্রী ও এমপি থাকাকালীন ১৫ বছরে রাজনৈতিক মোড়কে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কারণে দল থেকে জনপ্রতিনিধি নির্ধারণ করাও ছিল একটি বড় বাণিজ্য। তার এসব অপকর্মের মূল হোতা ছিলেন তার বড় ভাই ডা. জেআর ওয়াদুদ টিপু।
দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে চাঁদপুরে তার বাসায় বসত তদবির-বাণিজ্যের হাট। সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকায় বেচাবিক্রি হতো শিক্ষা প্রশাসনের নানা পদ।
ঘুষ-দুর্নীতি ছিল ওপেন সিক্রেট। শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার করার সুযোগে চাঁদপুরে তার বাসায় প্রায়ই চলে আসতেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, অধ্যক্ষ ও শিক্ষকসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
দীপু মনি হাসিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় একে একে শহর রক্ষা বাঁধ, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ৬০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে।
সাবেক এই মন্ত্রীর সবচেয়ে বড় টাকার মেশিন ছিল সদরের লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বালুখেকো সেলিম। নিজ স্বার্থের কারণে তাকে বারবার ডিও লেটার দিয়ে নির্বিচারে পদ্মা-মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে সুযোগ করে দেওয়া হয়।
অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাতিয়ে নেন মানুষের জমি। এদিকে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জমি অধিগ্রহণে তার ভাই টিপুসহ বাহিনীর সদস্যরা বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
একই সময়ে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েও শহর রক্ষায় স্থায়ী শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ভেস্তে যায়। এ ছাড়া দীপু মনির নির্দেশে সেলিম খান পদ্মা-মেঘনায় বালু তুলে শত শত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।
এসব দুর্নীতির কারণে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেলিম চেয়ারম্যানকে ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমা দিতে চিঠি দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। দীপু মনির এসব বাণিজ্যে স্থায়ী বাঁধ আর দেখেনি মেঘনা পাড়ের মানুষ।
বিগত সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প দিলেও কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। এসব প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। অচিরেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন চান জেলাবাসী এবং বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জনগণের।
এ ছাড়াও চাঁদপুরে দীপু মনির একান্ত অনুগত সব লুটপাট ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন বাহিনী প্রধান তার বড় ভাই টিপু, সাবেক মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল, জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান টুটুল, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী বেপারি, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম রোমান, পাকিস্তানি বংশধর সাইদুল ইসলাম বাবু ওরফে বিহারি বাবু। বিহারি বাবুর মাধ্যমে চলে সরকারি উন্নয়নের টাকা লুটপাটের সব কমিশন উত্তোলনের কাজ। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন বদলি বাণিজ্যসহ শিক্ষকদের হয়রানি করার মূল হোতা ছিলেন পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার।
দীপু মনির ক্ষমতাবলে তার বড় ভাই জেআর ওয়াদুদ টিপু হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরে ৪৮ একর সরকারি খাসজমি দখল করে গড়ে তোলেন ‘টিপু নগর’।
সেই জমি তিনি নিজ নামে দখলে নিয়ে তৈরি করেন মাছের ঘের, গবাদিপশুর খামার ও সবজি বাগান। যদিও বিষয়টি জানতে পেরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ সরকারি ভূমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে দীপু মনি ওই জেলা প্রশাসককে নেত্রকোনায় বদলি করে দেন।
দীপু মনির দেড় যুগের সাম্রাজ্যে ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলকে দমন, নিপীড়ন, হামলা-মামলা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে আওয়ামী পেটুয়া বাহিনীর দ্বারা জেলা বিএনপির অফিস এবং সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে, যা চাঁদপুরের ইতিহাসে ছিল বিরল।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দীপু মনির অনুসারী এবং লুটপাটে নিয়োজিত বাহিনীর সবাই আত্মগোপনে। তার ভাই টিপু দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আর দীপু মনি চাঁদপুর ও ঢাকার বেশ কয়েকটি মামলায় বর্তমানে কারাগারে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের বাসিন্দা কালু খান, মো. কাজল গাজী ও হাবিবুর রহমান বলেন, দীপু মনির নির্দেশে সেলিম চেয়ারম্যান বিশ্ববিদ্যালয় করবে বলে আমাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করেন। যারা যেতে চাননি তাদের অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে উচ্ছেদ করেছেন। দুর্নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ বাতিল হয়ে গেছে।
গাছতলা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম পাঠান বলেন, দীপু মনি নির্বাচন এলে উন্নয়নের ওয়াদা করতেন। কিন্তু তার ওয়াদা পালন হয়নি। আমাদের এলাকায় মেডিকেল কলেজ স্থাপন করবেন বললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
চাঁদপুর শহরের মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, টিপু ও রতন মজুমদারের মনমতো না হলেই ওই শিক্ষক হয়ে যেতেন বিএনপি-জামায়াত। যেমন আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিকুলামবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় আমাকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছিল।
চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার এলাকার বাসিন্দা মুসা ও ইকবাল বলেন, দীপু মনি বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে এখানে একটি স্থায়ী বাঁধ হবে। তো এখনও পর্যন্ত কোনো স্থায়ী বাঁধ করতে পারেননি। তিনি শুধু বড় বড় কথা বলেছেন কিন্তু বাস্তবে তা দেখাতে পারেননি।
চাঁদপুরের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে দীপু মনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগকে করেছেন কয়েক ভাগে বিভক্ত। এ ছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের একাংশকে নিয়ে একক রাজত্ব কায়েম করেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ দলীয় প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই ছিল তার চক্ষুশূল। তিনি তাদের ছাড়াই অগ্রহণযোগ্য নবীন নেতা ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
চাঁদপুর পৌর বিএনপির সভাপতি আক্তার হোসেন মাঝি বলেন, দীপু মনি আসার পর থেকে রাজনীতি অঙ্গনে অরাজকতা শুরু হয়। কোনো কারণ ছাড়াই বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে শত শত মামলা হয়েছে।
ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যে বিএনপির সভাপতির বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর করে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। দীপু মনির নির্দেশে তা করা হয়েছে। আর দীপু মনির দুর্নীতির কথা পুরো জেলাবাসী জানে। সেলিম চেয়ারম্যান ও তার ভাই টিপুকে দিয়ে সব বড় বড় দুর্নীতির কাজ হতো।
চাঁদপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সেলিম উল্লাহ সেলিম বলেন, বিগত প্রায় দেড় যুগে দীপু মনি তার লোকদের হাতে বিএনপি-জামায়াতের বহু নেতাকর্মী গায়েবি মামলার আসামি ও ঘর ছাড়া হয়েছেন। তার নিজের দলের লোকজনও রক্ষা পাননি। জুলুম ও নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরা তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জবাব নিতে অপেক্ষায় আছেন।









































