ধানের বাম্পার ফলন ছয় জেলায়
ডিসেম্বর ২৭ ২০২২, ১০:১৪
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল বিভাগে এবার আমনের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলনের পাশাপাশি বাজারে ধানের দামও মোটামুটি ভালো পাওয়ায় খুশি এ অঞ্চলের কৃষকরা।
বিভাগের ছয় জেলা পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা ও বরিশাল জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার অধিক ফসল উৎপাদন হয়েছে বলে জানালেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের মতে হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে ধান নদী খালের বরিশাল।
সরেজমিনে ২৬ ডিসেম্বর সোমবার জেলার বাকেরগঞ্জের চরামদ্দি ইউনিয়ন, দুধল, কবিরাজ, সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে খেলা করছে সোনালি ধান। কোথাও কোথাও ধান কেটে মাড়াইয়ের কাজও শুরু হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ কাক ডাকা ভোরে উঠে পাকা ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিটি কৃষক পরিবারেই উৎসব আমেজ এখন। তবে বর্তমান বাজারে ৯০০ টাকা মন হওয়ায় লাভের পরিমাণ খুবই কম বলে দাবী কৃষকদের। যদিও বরিশালের অন্য জেলার কৃষকদের সাথে ফোনে কথা বলে জানা গেছে, তারা যা দাম পাচ্ছেন তাতে খুশি।
কেউ কেউ আরেকটু বেশি লাভের মুখ দেখতে চান। বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক হারুন অর রশীদ জানালেন, গত বছরের তুলনায় বরিশাল জেলায় ৫৭ হেক্টর জমিতে এবার ফসল বেশি হয়েছে। জেলায় মোট ১ লক্ষ ২৫ হাজার ৫৭ হেক্টর জমিতে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে বলা যায়। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগে ৬ লাখ ৬৭ হাজার মেট্রিক টন আমন ধান উৎপাদন হবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা। করোনাকালীন সংকট মূহুর্তে সারা বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা গেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও ফাঁকা রাখতে নিষেধ করেছেন এবং কাঠাল উৎপাদনে মনোযোগী হতে কাঠালের বার্গার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এমতাবস্থায় বরিশাল বিভাগে চলতি বছর আমন, বোরো, আউশ এই তিন ফসল মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ মেট্টিক টন অতিরিক্ত চাল উৎপাদিত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) এই বিভাগে তিন ফসল মিলিয়ে চাল উৎপাদিত হয়েছিলো ২৮ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) তা বেড়ে হয়েছে ৩১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন।
লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি ছাড়াও ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে দক্ষিণাঞ্চলে গত কয়েক বছর ধরে খাদ্য উৎপাদনের এই অগ্রগতিতে খুশি কৃষি বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যে ভোলা ঘুরে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ভোলার কৃষকদের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন।
বিশ্বব্যাপী যখন খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, সেখানে বরিশালের কৃষকেরা করোনা ও জলবায়ুর বিরূপতা মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। বিভাগের প্রায় এককোটি জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমানে খাদ্যের চাহিদা ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টন। যা মিটিয়ে ১৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরিশালের ছয় জেলায় বোরো উৎপাদন হয়েছিলো ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিলো প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৩ মেট্রিক টন থেকে ৭ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু আবাদ বেশি এবং ফলন ভালো হওয়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন চাল।
বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুধল ইউনিয়নের সাবেক সেনাসদস্য ও কৃষক আব্দুল বাতেন বলেন, ‘যুগের পর যুগ একটি ফসল করে আমরা ধুঁকছিলাম। ধান উৎপাদনে যে খরচ, তাতে আসলই ওঠে না। লাভ তো দূরের কথা। কিন্তু এবার প্রথম দুই একরে বোরো আবাদ করেছিলাম। ফলন ভালো হয়েছে এবং দামও ভালো পাওয়ায় লাভের মুখ দেখেছি।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার সাংবাদিক ও কবি জাহাঙ্গীর হোসাইন মানিক জানালেন, তার এলাকায় কৃষি উৎপাদন এবছর খুবই ভালো। তিনি ফল চাষে গুরুত্ব দিলেও তার প্রতিবেশীরা প্রায় সবাই তাদের জমিতে এবার তিন ফসল করেছেন। কেউই আর জমিকে আর পতিত রাখতে চায় না। তারা আমন, আউশ, বোরো এখন তিন ফসলই করছে বলে জানান কবিয়াল খ্যাত মানিক।’
বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বিভাগে আমন, আউশ, বেরো মিলিয়ে প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ধারাবাহিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে আমনে বেশ ক্ষতির পরেও আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন ১ লাখ মেট্রিক টন বৃদ্ধি পেয়ে তিন মৌসুম মিলিয়ে বিভাগে প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছিলো। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই উৎপাদন সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টনের বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে চলতি বছর বিভাগে আমন উৎপাদন হয়েছে ১৭ লাখ ৯৪ হাজার ৩৭০ মেট্রিক টন, আউশ ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন এবং বোরো ৭ লাখ ১৪ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বরিশালের অতিরিক্ত পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. হারুন অর রশীদ আরো বলেন, বাংলার শস্যভান্ডার হিসেবে বরিশাল অঞ্চলের পুরনো খ্যাতি আবার ফিরতে শুরু করেছে। গত টানা তিন বছর এ অঞ্চলের চাল ও অন্য শস্যের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। কৃষকদের প্রচেষ্টা এবং কৃষি বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ, নতুন নতুন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, সুবিধা ও প্রণোদনা বৃদ্ধির কারণে এই সাফল্য অর্জিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।








































