দীর্ঘ ৭৬ বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত গান্ধী আশ্রমে

ডিসেম্বর ১৫ ২০২২, ১৪:৫৮

জিয়াউল হক, বরিশাল।। জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী ইউনিয়নের বেবাজ গ্রামে প্রায় সাড়ে ১২ একর জায়গা নিয়ে ১৯৪৬ সালে গড়ে ওঠে গান্ধী সেবাশ্রম। বর্তমানে এই গান্ধী আশ্রমে নেই কোনো কার্যক্রম। সরকারি-বেসরকারি ও স্থানীয় পর্যায়ে দেখভালের অভাবে বাকেরগঞ্জের গান্ধী আশ্রমটি নিশ্চল প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে ।

জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীর নামে ৭৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় এই আশ্রমটি। গান্ধীবাদী নেতা সতীন্দ্রনাথ সেন, বিনোদ কাঞ্জিলালসহ গান্ধীবাদী নেতারা এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৬ সালে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠার পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর ভ্রাতুষ্পুত্র কানু গান্ধী ও তার স্ত্রী আভা গান্ধী।

আরো জানা যায়, প্রথমে ছয় একর জায়গায় আশ্রমটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে আশ্রমের পূর্বতন সম্পাদক রাম চট্টোপাধ্যায় আশ্রমের জন্য আরো সাড়ে ছয় একর জমি দান করেন। বর্তমানে আশ্রমের জায়গায় ৪টি পুকুর ও একটি প্রাইমারি স্কুল গড়ে উঠলেও আশ্রমটির কোনো দৈনন্দিন কার্যক্রম নেই।

স্থানীয়রা জানান, আগে আশ্রমটির নাম ছিলো ‘গান্ধী সেবাশ্রম’। এখানে একটি লাইব্রেরী, বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র, মৌমাছি পালন, চরকায় সুতা কাটা, বনায়নসহ বহু জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম ছিল। আশ্রমের উদ্যোগে রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, বালিকা বিদ্যালয় পুন: গঠনসহ স্থানীয় দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেয়া হতো।

মূলত স্বদেশি ভাবনায় পল্লী সমাজ পুন:গঠনের মাধ্যমে দেশমাতৃকার সেবার মানসিকতায় এই আশ্রম গড়ে উঠেছিলো। বর্তমানে বহু পুরোনো একটি টিনের ঘর ও নবনির্মিত একটি একচালা টিন সেট পাঁকা ঘর অসম্পূর্ণ রয়েছে। এখানে গান্ধীজির একটি ভাস্ককর্য নির্মাণ করা হলেও এটি স্থাপন করা হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৫৫ সালে আশ্রমের অন্যতম উদ্যোক্তা সতীন্দ্রনাথ সেন মারা গেলে তার অনুসারীদের উদ্যোগে গান্ধী সেবাশ্রম নাম বদলে সতীন্দ্র স্মৃতি গান্ধী আশ্রম নামকরণ করা হয়। আশ্রমের মধ্যেই প্রতিষ্ঠাতা বিনোদ কাঞ্জিলাল, উদ্যোক্তা সতীন্দ্রনাথ সেন ও পূর্বতন সম্পাদক রাম চট্টেপাধ্যায়ের সমাধি ও সমাধিস্মারক রয়েছে।

১৯৭১ সালে আশ্রমের একটি কাঠের ঘর কাগজপত্রসহ পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানিরা। এ ছাড়া আশ্রমসংলগ্ন বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে আশ্রমের বেশ কয়েকজন সদস্যদেরকে হত্যা করা হয়।

আশ্রমের সম্পাদক শ্যামলাল হালদারের ছেলে অমৃত হালদারও পাকিস্তানি আর্মির গণহত্যার শিকার হন। পরে ১৯৭২ সালে আশ্রমের উদ্যোগে অমৃত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে এটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।

বর্তমান গান্ধী আশ্রমের সাধারন সম্পাদক দাবিদার চন্দ্র নাথ চক্রবর্তী জানান, আমরা ২০২১ সালে একটি রেজুলেশন করে বরিশাল সমাজসেবা কার্যালয় থেকে কমিটির অনুমোদন পেয়েছি। সেই কমিটির সভাপতি মনিরুজ্জামান।

আমরা ২০২১ সাল থেকে আশ্রমের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গেলে আমাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন স্বঘোষিত কমিটিতে থাকা সাধারণ সম্পাদক তপঙ্কর চক্রবর্তী আদালতে দুটি মামলা করেন। যা এখনো চলমান রয়েছে।

গান্ধী আশ্রমে ২০০৫ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য পারভীন তালুকদার হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্থ স্থাপন করেছিলেন। এখানে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারি সহায়তার অভাবে তা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

ইতোমধ্যে আশ্রমটি পরিদর্শন করেছেন রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য, নির্মল সেন, বারডেম পরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ, বাংলা ক্রাফটের পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান, বরিশালের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল আলম, পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্য, জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক খান আলতাফ হোসেন ভুলু, সংসদ সদস্য পারভীন তালুকদার, অধ্যক্ষ গণেশ হালদার, ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি আশোক সেন প্রমুখ।

তিনি আরো জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে নামে মাত্র থাকা স্বঘোষিত কমিটির লোকজনরা আশ্রমের উন্নয়ন কাজের নামে আশ্রমে থাকা গাছ বিক্রি করে ১০/ ১২ লাখ টাকা আত্নসাৎ করেছেন। এমনকি তারা দীর্ঘদিন কমিটিতে থাকলেও তাদের নেই কোন রেজুলেশন নেই কোন একটি ব্যাংক একাউন্ট।

এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও দেশ বিদেশ থেকে কোন অনুদান আসলেও তা আশ্রমের উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হয়নি। তবে আশ্রমটি সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা গেলে তা হবে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। আশ্রমটি আগের জনকল্যাণ কার্যক্রমের ধারায় ফিরিয়ে আনতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

এ বিষয়ে তপঙ্কর চক্রবর্তী জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে রেজুলেশনের মাধ্যমে গান্ধী আশ্রমের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছি। আলাউদ্দিন হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে গান্ধী আশ্রমের সদস্য ছিলেন। মুলত আশ্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ মারা গেলে তার পরিবার থেকে একজন আশ্রমে নেয়া হয়।

কিন্তু আলাউদ্দিন হাওলাদার মৃত্যুর আগেই তার পুত্র মনিরুজ্জামান সভাপতি দাবি করে আসছেন। মনিরুজ্জামান বরিশাল সমাজ সেবা কার্যালয় থেকে টাকার বিনিময়ে কমিটির অনুমোদন করিয়েছেন। সেই কমিটিতে মনিরুজ্জামান সভাপতি ও চন্দ্র নাথ চক্রবর্তী সাধারণ সম্পাদক দাবি করে আসছেন।

আশ্রম থেকে গাছ বিক্রির বিষয়ে তপঙ্কর চক্রবর্তী জানান, আমার জানা মতে একবার ৮০ হাজার টাকার গাছ বিক্রি করা হয়েছে। তবে সেই টাকা আশ্রমের নতুন ভবন নির্মাণের কাজে লাগানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।

কলসকাঠীর বেবাজ গ্রামের মৃত্য রাম প্রসাদ ঘোষের স্ত্রী শংকরী রানী ঘোষ ভূমিহীন ও গৃহীন তাই তার পরিবারের ৫ জন সদস্য নিয়ে ৩৫ বছর যাবৎ বসবাস করে আসছেন আশ্রমে।

আশ্রমে বসবাসকারী এক সদস্য জানান, আশ্রমে কোনো কার্যক্রম নেই। উন্নয়নের কিছুই হচ্ছে না। দিন দিন আশ্রমটি অবহেলা ও অযত্নে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। উপরে টিনের চালায় মরিচা পরে খোসে পরছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি ঘরের ভিতর ঢুকে পরে।

দরজা-জালনা গুলোও ভেঙ্গে গেছে। অনেকেই এসেছেন আশ্রম পরিদর্শন করতে অনুদানও দিয়েছে তবে তা কোথায় গেছে কারো জানা নেই। আশ্রমটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবী জানান তিনি।

এ বিষয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার সজল চন্দ্র শীল জানান, দুই গ্রুপের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে গান্ধী আশ্রমের উন্নয়ন দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ রয়েছে। আশ্রমের বাইরে যেসব জমিতে ধান চাষাবাদ হয়েছে।

ধান ও পুকুরের মাছ বিক্রি করে উপজেলা কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জমাকৃত টাকা দিয়ে আশ্রমের সংস্কার কাজ করা হবে। এছাড়া আশ্রমটি সরকারি আওতায় আনার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

আ/ মাহাদী

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও