দেশে বেড়েই চলছে শিশুশ্রম

অক্টোবর ২১ ২০২৩, ১০:২২

ডেস্ক প্রতিবেদক ‍॥ পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকা। ভারী ইঞ্জিনের দোকানে দৈনিক ২০০ টাকা হাজিরায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে ১০ বছর বয়সি রাকিব। তার সাথে কথা বলতেই জানা গেল, স্কুলে যাওয়ার বয়সে সে এখানে কাজ করছে কেন। রাকিব বলল, গত বছর তার বাবা মারা গেছে। তারা তিন ভাইবোন।

তাদের মা অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারে না। ১৩ বছর বয়সি তার এক বড় ভাইও ধোলাইখালে একটি দোকানে কাজ করে। আর ছোট বোনের বয়স চার বছর। পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে কি-না এমন প্রশ্নে রাকিব বলে, সে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর অর্থ অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে চলে আসতে হয়েছে।

মীরহাজীরবাগ এলাকার ওয়ার্কশপে ঝালাইয়ের কাজ করছে ১৪ বছর বয়সি জিহাদ হোসেন। তার সাথে কথা বলতেই জানা গেল, বই-খাতা হাতে থাকার বয়সে তার হাতে কেন ঝালাই মেশিন। জিহাদ বলে, পরিবারে মা-বাবা, ভাইবোনসহ সদস্য সাতজন। বাবার একজনের আয়ে পরিবার চলে না।

পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর থেকে ওয়ার্কশপে কাজ করছি। ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে সে কোনো দুর্ঘটনায় শিকার হয়েছে কি-না। এমন প্রশ্নে জিহাদ জানান, মাঝে মধ্যে ঝালাইয়ের আগুন হাতে লাগে। তবে একবার বাম হাতের দুটো আঙ্গুল পুড়ে যায়। চিকিৎসা নিলে সেরে যায়।

রাকিব ও জিহাদের মতো শিশুশ্রমিক কাজ করছে দেশজুড়ে বিভিন্ন কলকারখানা, গার্মেন্ট, দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তাদের বেশির ভাগের গল্পই পারিবারিক অভাব-অনটন। জিঞ্জিরায় একটি মেশিনারিজ পার্টস তৈরির কারখানায় কাজ করছেন চার থেকে ছয় শিশু। কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদকে বলেন, তাদের বয়সি আমারও দুটো ছেলে আছে। তারা দুজনই স্কুলে পড়ে। শিশুশ্রম ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার কারাখানায় যারা কাজ করে তারা সবাই আর্থিক সমস্যা থেকেই কাজ করতে এসেছে। কারও বাবা আছে কারও মা আছে। তিনি শিশুশ্রমকে অপরাধ মনে করেন কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি তাদের কাজ দিয়েছি। আমি কাজ দিলে তারা অন্য কোথাও কাজ করত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, দেশে এখন শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। তাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। শ্রমজীবী শিশুদের ১০ লাখ ৬৮ হাজারই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত। ঝুঁকি নেই এমন কাজে যুক্ত আছে সাত লাখ সাত হাজার শিশু। বিবিএসের জরিপে পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাঁচ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের ধরলে দেশে এখন শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার। দেশে এখন পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা তিন কোটি ৯৯ লাখ। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে বিবিএস যে জরিপ করে তাতে দেশে তখন মোট শিশুশ্রমিক ছিল ১৬ লাখ ৯৮ হাজার। এই সময়ে শিশুশ্রমিক না কমে উল্টো ৭৭ হাজার বেড়েছে।

তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের সংখ্যা সামান্য কমেছে। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার। গত ১০ বছরে তা দুই লাখ ১২ হাজার কমেছে। অর্থনৈতিক খাতগুলো বিবেচনা করে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সি মোট শিশুদের মধ্যে ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৫৫৯ শিশু কৃষিতে কাজ করে।

১১ লাখ ৯১ হাজার ৮০৬ শিশু শিল্প খাতে কাজ করে। ১২ লাখ ৭০ হাজার ৪৩১ শিশু সেবা খাতে নিয়োজিত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞায় পাঁচ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত শিশু ধরা হয়। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ১১ বছরের শিশুরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা, ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সি শিশু সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টা এবং ১৪ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করালে তাকে শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম পুরোপুরি দূর করতে দুই হজার ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু তাতে শিশুশ্রমিক না কমে উল্টো বাড়ছে।

আর বাংলাদেশের শ্রম আইনে ১৪ বছর বয়সের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। কিন্তু দেশে মোট শিশুশ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি ওই বয়সের। দেশের শিশুশ্রম ও এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক কথা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদের সাথে।

তিনি বলেন, শিশুশ্রম বাড়ার কারণ হিসেবে দারিদ্র্যতাকে চিহ্নিত করা যায়। দারিদ্র্যতার কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে শিক্ষার্থীরা। অল্প বয়সে পরিবার থেকে অর্থ উপার্জন করার জন্য তাদের কাজে পাঠানো হয়। আমরা করোনাকালীন সময়ে দেখেছি দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিশু স্কুল খোলার পর স্কুলে ফিরে আসেনি। তারা পরিবার বা সামাজিক নানান প্রতিবন্ধকতার চাপে পড়ে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের একটি অংশকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়।

এতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক সময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তাদের অঙ্গহানি হয়ে থাকে। তা ছাড়া যে সব শিশুরা শিশুশ্রমে যুক্ত তাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এতে দেখা যায় তারা ৪০ বছর বয়সের মধ্যে কর্মক্ষমতা হারায়।

তিনি আরও বলেন, শিশুশ্রম রোধে আমাদের দেশে শিশুদের জন্য যেসব প্রকল্প চালু আছে সেসব প্রকল্প সঠিকভাবে কাজ করছে না। এসব প্রকল্প যথাযথ তদারকি করা প্রয়োজন। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে যে উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি। সে স্বপ্নের সাথে শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়া মানানসই না। শিশুশ্রম রোধে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও