দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে নগরের ২৪ খাল

আগস্ট ০৬ ২০২৩, ১৯:০৪

এম মিরাজ হোসাইন, অতিথি প্রতিবেদক ‍॥ কীর্তনখোলা নদী থেকে বরিশাল নগরীতে প্রবেশ করা ২৪ খাল দখল-দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে। গত ২০ বছরে অনেক খাল সড়ক ও ড্রেনে পরিণত করেছে খোদ নগর কর্তৃপক্ষ। টিকে থাকা খালগুলোও মৃতপ্রায়। অপরিকল্পিত নগরায়ণে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে ২২টি খাল। এর মধ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়া সাতটি খালের প্রাণ ফেরাতে এবার উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ফলে নগরীর কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া আমানতগঞ্জ, রূপাতলী, পলাশপুর, সাগরদী, চাঁদমারী, জেলখাল ও ভাটার খাল দীর্ঘদিন পর হলেও আগের চেহারা ফিরে পেতে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, একসময় বরিশাল নগরীতে খাল ছিল ৪৬টি। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ২২টি খাল সড়ক ও স্থাপনায় বিলীন হয়ে গেছে। আর এখন অপরিকল্পিত নগরায়ণে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে বাকি ২৪ খাল। এ খালগুলো হলো লাকুটিয়া, নথুল্লাবাদ, ভাটার, ভেদুরিয়া, বানিয়াকাঠীর, বাগিয়ার, সাগরদী, ভাড়ানী, নাপিতখালি, আমানতগঞ্জ, চাঁদমারী, কলাডেমা, নবগ্রাম, পুডিয়া, হরিনাফুলিয়া, সাপানিয়া, জাগুয়া, কাশিপুর, ঝোড়াখালি, সোলনা, টিয়াখালি, কড়াপুড়, উত্তর কড়াপুর ও জেলখাল। বাকি ২২ খালের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ তা সড়ক ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বিলীন হয়ে গেছে।

পাউবো সূত্র জানায়, সাতটি খালের নগর অংশের ১২ কিলোমিটারের বেশি খনন ও উদ্ধারের জন্য ২০২২ সালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম উদ্যোগ নেন। কিন্তু তিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের। দুই দফায় দরপত্র আহ্বানের পরও তা বাতিল করতে হয়। সম্প্রতি সিটি নির্বাচনের পর সেই বাধা কেটে গেছে। ফলে তৃতীয় দফায় ফের দরপত্র আহ্বান করেছে পাউবো। গত ৪ জুলাই দরপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। মূল্যায়নের পর কার্যাদেশ দিয়ে মূল কাজে ফেরার চেষ্টা চলছে। চলতি মাসে না হলেও আগামী সেপ্টেম্বরের শুরুতে সাতটি খালের নগর অংশের ১২ কিলোমিটারের বেশি খাল খনন এবং পুনরুদ্ধারকাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন পাউবোর পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসাইন।

তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে সাতটি খালের বরিশাল নগর অংশে খনন ও পুনরুদ্ধারে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অসহযোগিতার কারণে খাল উদ্ধার সম্ভব হয়নি। মেয়র তখন নগরীর কাজ নিজেই করবেন বলে পাউবোকে বাধা দেন। তবে নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের সহযোগিতায় খাল উদ্ধারে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। খালগুলো উদ্ধার হলে নগরবাসী জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাবে।’

বরিশালের নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলন ও সেভ দি কোস্ট্যাল পিপলের (স্কোপ) সমন্বয়কারী কাজী এনায়েত হোসেন শিবলুর মতে, ‘১৯০৬ সালের ১৫ এপ্রিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরায় করে বরিশালে এসেছিলেন। তাকে বহনকারী বজরা ভিড়েছিল কীর্তনখোলা নদীসংলগ্ন ভাটার খালে। বরিশালের রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া খাল-বিল-পুকুর-নদী পরিবেষ্টিত বরিশালের রূপে মুগ্ধ হয়ে এই বরিশালকে বাংলার ভেনিস আখ্যায়িত করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’

প্রবীণ সাংবাদিক এসএম ইকবাল জানিয়েছেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত আহসান হাবিব কামাল পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকার সময় খাল ভরাট ও দখল শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে বটতলা খাল ভরাট করে দোকানপাট নির্মাণ করে পৌর কর্তৃপক্ষ। ২০০০ সালে প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। শুরুর দিকে কিছুদিন মেয়র ছিলেন আহসান হাবিব কামাল। সে সময় খালটির বটতলা থেকে হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা পর্যন্ত অংশ ভরাট করা হয়। তাছাড়া ২০০৩ সালে বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর খালের নবগ্রাম থেকে বটতলা মার্কেট পর্যন্ত খাল ভরাট করা হয়। এছাড়া আওয়ামী লীগের তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরণের সময় বটতলা খালের ওপর নির্মাণ করা হয় সড়ক। একইভাবে তিনি নগরীর ভাটার খালের সার্কিট হাউজের পেছনের অংশে খালের ওপর ড্রেন ও সড়ক নির্মাণ করেন। তাছাড়া জেলখালের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয় কয়েকটি বক্স কালভার্ট। এ কারণে জেলখালে এখন নৌকা প্রবেশ করতে পারে না।

অপরিকল্পিত উন্নয়নের পাশাপাশি খালগুলোর পাড় দখল করে বাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়, যা এখনো দৃশ্যমান। এর আগে জেলখালসহ নগরীর অন্যান্য খাল উদ্ধারে জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। স্থানীয়দের অংশগ্রহণে খালের সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা আবার দখল হয়ে যায়। যদিও বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নগরীর সব খাল উদ্ধার ও খননের জন্য একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুরোধে নগরীর সাতটি খাল খনন ও উদ্ধার প্রকল্প গ্রহণ করেছিল পাউবো। এমনকি সাতটি খাল খননের জন্য অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। কিন্তু রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে শেষ পর্যন্ত সেই প্রকল্প দুই বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি।

পাউবোর পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসাইন জানান, পাউবোর সাতটি খাল খনন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় নগরীর আমানতগঞ্জ খালের ৩ কিলোমিটার, জেলখালের ২ কিলোমিটার, রূপাতলী খালের ১ দশমিক ১ কিলোমিটার, পলাশপুর খালে ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার, সাগরদী খালের সর্বোচ্চ ৯ কিলোমিটার, চাঁদমারী খালের ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার এবং ভাটার খালের দৃশ্যমান পুরো অংশ অর্থাৎ ১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার খনন করা হবে। এজন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৭১ লাখ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও