বেতাগী সাব-রেজিস্ট্রি অফিস: প্রতি দলিলে বাড়তি টাকা দিতে হয় সহকারীকে!
আগস্ট ০৪ ২০২৩, ১৩:৩৬
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: বরগুনার বেতাগী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসটি ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এ অফিসে সরকারি কোনো বিধান মানা হয় না। ইচ্ছেমতো দলিল রেজিস্ট্রি ফি আদায় করা হয়। দানপত্র বা হেবা দলিল রেজিস্ট্রি করতেও অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী সাইদুজ্জামান সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিচ্ছেন নানা কৌশলে। গত দুই বছরে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকেই অভিযোগ করেন।
জানা গেছে, গত ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ এর ৩০ জুনের মধ্যে এই উপজেলায় সাফ-কবলা দলিল হয়েছে এক হাজার ৭৯৭টি, দানপত্র দলিল ৮১৮টি, হেবা বিল এওয়াজ দলিল ১৩৮টি, হেবা ঘোষণাপত্র দলিল ৪৭৮টি, বন্দবস্ত দলিল ১৬১টি এবং অন্যান্য ৮৭টি-সহ মোট তিন হাজার ৪৭৯ টি দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। এ থেকে গত একবছরে ছয় কোটি ৫৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬২২ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে।
জানা গেছে, সরকারি নিয়মানুযায়ী রেজিস্ট্রেশনে পৌরসভার মধ্যে দলিলপ্রতি সাড়ে আট শতাংশ এবং মফস্বলের দলিলপ্রতি সাড়ে সাত শতাংশ ফি নেওয়া নিয়ম থাকলেও অফিস সহকারী সাইদুজ্জামান দলিলপ্রতি অতিরিক্ত এক থেকে তিন শতাংশ টাকা নিয়ে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি।
এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গত বুধবার (২ আগস্ট) সকাল ১১টার দিকে সরেজমিনে বেতাগী উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের সাথে কথা বলতে চাইলেও সেসময় তাকে পাওয়া যায়নি।
এরপর তার মুঠোফোনে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একাধিক বার ফোন দেওয়া হলেও উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার নূরুল আফছার ফোন রিসিভ করেনি।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিধান অনুযায়ী দলিলে সরকার নির্ধারিত মোট ৫৪০ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছেন অফিস সহকারী সাইদুজ্জামান।
দলিলের সই মোহরকপি পাতাপ্রতি জেএ ১৫ টাকা করে জেপি ১৬ টাকা, জিজি ২৪ টাকা করে মোট নকলের ওপর এক হাজার ২০০ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও নেওয়া হয় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা।
এছাড়াও একটি দলিলের নকল কপিতে সাবরেজিস্ট্রার নেন ২৫০ টাকা করে। এর ফলে দলিলদাতা ও গ্রহিতা উভয়ই আর্থিক ক্ষতিসহ হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
অফিস সূত্রে জানা গেছে, বেতাগী সাব-রেজিস্ট্রার কর্মকর্তা সপ্তাহে একদিন শুধু অফিস করেন। তিনি কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন শুধু বুধবার। তিনি সাব-রেজিস্ট্রার নূরুল আফছার বেতাগী ছাড়াও বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলী উপজেলাসহ তিনটি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন।
এ উপজেলায় একদিন অফিস করলেও অফিসের রাজত্ব থাকে অফিস সহকারী সাইদুজ্জামানের নিয়ন্ত্রণে। কোন দলিল আগে হবে, নকল নবীশ কারা আগে পাবে- এসবের নিয়ন্ত্রণ সাইদুজ্জামানের হাতে। তিনি ২০২১-এর ৩০ জুন বেতাগী সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যোগদান করেন।
গত দুই বছরে তিনি এই উপজেলা থেকেই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এমন অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদনের জন্য তথ্য সংগ্রাহ করার কাজে সরেজমিনে গেলে এক দলিললেখক জানান, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের অফিস সহকারী সাইদুজ্জামান ওরফে মাসুদ মিয়া প্রতি বুধবার দুই-তিন লাখ টাকার বেশি অফিস খরচের কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছেন।
অভিযোগের বিষয় বেতাগী সদর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরা গ্রামে রাফসান বলেন, সদ্য দলিল রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে অফিস সহকারী আমার কাজ থেকে অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা নিয়েছেন।
কারণ হিসেবে তিনি বললেন, অফিসের খরচ আছে। রাফসান আরো বলেন, তিনি বেতাগী পৌরসভা এলাকা থেকে তিন শতাংশ জমি হেবা দানপত্র গ্রহণ করেন। তার কাছে চার হাজার টাকা অফিস খরচের জন্য দাবি করেন ওই সহকারী।
গতমাসে ওই একই লক্ষ্মীপুরা গ্রামের আব্দুর রহমান নামে আরো একজন বলেন, পৌরসভা এলাকায় আট শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করতে অফিস খরচের বরাত দিয়ে দুই হাজার টাকা নিয়েছেন। তার কাছেও চার হাজার টাকা দাবি করেছেন।
তিনি আরো বলেন, তার জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার পরও শতাংশ প্রতি আরো ৩০০ টাকা করে মোট দুই হাজার ৪০০ টাকা দিতে হয়েছে। এসময় আরেকজন দলিললেখক বলেন, মোগো নাম ল্যাখিও না, অফিস সহকারী সাইদুজ্জামান মাসুদ সরকারি নিয়মে পৌরসভার মধ্যে সাড়ে আট শতাংশ এবং পৌরসভার বাহিরে ইউনিয়ন থেকে দলিলপ্রতি সাত শতাংশ হারে টাকা নেওয়ার বিধান থাকলেও অফিস সহকারী নিচ্ছেন নয় থেকে এগারো শতাংশ হারে।
এতে করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এমন অনেকেই এই বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়ে সম্মতি দেন। উপজেলার মোকামিয়া ইউনিয়নের চালিতা বুনিয়া গ্রামের রতন হাওলাদার বলেন, সরকারি ফিস জমা দেওয়ার পর অবিকল কপি পেতে সাত-আট দিন সময়ের কথা বললেও দেড় হাজার টাকা দিয়ে তিন মাস ঘুরতে হয়েছে।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী সাইদুজ্জামান বলেন, আমরা সরকারি বিধান অনুযায়ী অফিস পরিচালনা করি। অতিরিক্ত কোনো টাকা নেওয়া হয় না।
এ বিষয় বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমেদ বলেন, সরকারি নিয়মের ব্যতিরেকে কেউ টাকা নিতে পারবে না। অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সরকারি বিধান অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।









































