কোটি টাকার লেনদেন হয় বৈঠাকাটার ভাসমান সবজির হাট

নভেম্বর ১১ ২০২৫, ১৬:১৬

ভোরের আলো যখন বেলুয়া নদীর শান্ত জলে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই নীরবতা ভেঙে ভেসে আসে শতাধিক নৌকার ডাক। নৌকায় কেউ আনছে শাকসবজি, কেউ চালডাল, কেউবা মাছ, হাঁস-মুরগি, নদীতে পাওয়া যায় চা-পিঠা। নদীর বুকে যেন বেজে ওঠে এক অপূর্ব সংগীত। মাঝির বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ট্রলারের ইঞ্জিনের চিৎকার, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক আর ঢেউয়ের তালে জেগে ওঠে জনপদ।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বেলুয়া নদীর বৈঠাকাটা ভাসমান হাটের স্বাভাবিক চিত্র এমনই। বৈঠাকাটাকে বিবেচনা করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদীভিত্তিক হাট হিসেবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান আর বাজার ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম এই হাট। ফলে বেলুয়া নদী শুধু নৌকা বয়ে আনছে না, নিয়ে আসছে নানান মানুষের জীবনের গল্প। চাষি, ব্যবসায়ী, মাঝি, খেটে খাওয়া মানুষের সংস্থান নির্ভর করে এই বহমান স্রোতেই।

প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই নদী বদলে যায় এক প্রাণচঞ্চল বাজারে। হাটবারে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বেচাকেনা। বর্ষায় সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত, আর শীতে বেলা ১০টা পর্যন্ত চলে লেনদেন।

পিরোজপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার উত্তরে এবং নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বৈঠাকাটা হাটে পৌঁছাতে হয় নৌকায়। কারণ, নাজিরপুরের এ অঞ্চলটি মূলত বিলাঞ্চল, সড়কপথের চেয়ে নৌপথই এখানে বেশি সহজলভ্য। ভাসমান হাটে স্থানীয় প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায় শাকসবজি, চালডাল, মাছ-মাংস, গাছের চারা, শ্যাওলা, হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে ভাসমান নৌকায় নাশতার দোকান পর্যন্ত।

পিরোজপুর ছাড়াও বরিশাল, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট ও শরীয়তপুর জেলা থেকেও ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন।

বছরের পর বছর ধরে এ বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক আব্দুল হকের।

তিনি জানান, এখান থেকে চারা ও সবজি পাইকারি কিনে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ, বাগেরহাটের মোংলা, শরনখোলা, মোরেলগঞ্জে নিয়ে খুচরা বিক্রি করি। প্রথম যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন ডিঙ্গি নৌকা ছিল, এখন আমার বড় স্টিলের ট্রলার হয়েছে। এখানে চাষ করা চারা ও সবজির মান ভালো। এ হাটের চারা ও সবজি শুনলে ক্রেতার অভাব হয় না।

নাজিরপুর উপজেলার পাশবর্তী বিশারকান্দি এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী এনায়েত বাহাদুর বলেন, আমি ৪০ বছর এই বাজারের সঙ্গে জড়িত। এখান থেকে মাল কিনে ভোলা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি করি। এ হাটের সঙ্গে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ জড়িত। নৌযান ছাড়া যোগাযোগের কোনো মাধ্যম এখনো নেই।

নিজের উৎপাদিত সবজি ও চারা ভাসমান হাটে বিক্রি করতে স্থানীয় সোনাপুর গ্রাম থেকে আসছেন কৃষক আজাদ শেখ।

তিনি বলেন, বাপের সঙ্গে আগে হাটে আসতাম, এখন নিজে আসি। আপনারা সাংবাদিকেরা যেমন আমাদের দেখতে আসেন, সরকার যদি এমন আমাদের দেখত, তাহলে আমরা এতটা অবহেলিত থাকতাম না।

ভাসমান হাট থেকে তরকারি কিনে লঞ্চে করে ঢাকা নিয়ে বিক্রি করতেন লাবু মোল্লা। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে লঞ্চ বন্ধ হয়ে যায়, তার আর আগের মতো লাভ আসে না। লঞ্চ চালু না থাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে। লঞ্চ সার্ভিস চালু থাকলে আমাদের পণ্য সহজে ঢাকায় পাঠানো যেত। এদিকে গাড়িতে পাঠাব, তাও পারি না—বৈঠাকাটা থেকে নাজিরপুর পর্যন্ত রাস্তা ভাঙা।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাসানত ডালিম জানান, বৈঠাকাটা ভাসমান হাটকে ঘিরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল সরাসরি এনে বিক্রি করেন, ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কম এবং কৃষক পান ন্যায্য দাম। প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হয় এই হাটে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজিয়া শাহনাজ তমা বলেন, বৈঠাকাটা ভাসমান বাজারটি বাংলাদেশের বৃহত্তম ভাসমান বাজার। বাজারটির বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, এর উন্নয়নে আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা করছি, যা দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে।

বৈঠাকাটা ভাসমান হাট শুধু একটি বাজার নয়, এটি নদীভিত্তিক দক্ষিণাঞ্চলের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। নৌকাভিত্তিক এই হাট গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও ধারক।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

আমাদের ফেসবুক পাতা

আজকের আবহাওয়া

পুরাতন সংবাদ খুঁজুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০

এক্সক্লুসিভ আরও