নিজস্ব প্রতিবেদক: গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে নিত্যপণ্যের বাজারে বেড়েছে সব ধরনের পণ্যের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। এছাড়া আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল, চিনি এবং সবজির বাজার ঊর্ধ্বগামী। এদিকে পেঁপে ছাড়া বাজারে অন্য প্রায় সব সবজিরই কেজি এখন ৫০ টাকার ওপরে। শীত আসার আগ পর্যন্ত এ দাম এমন থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিক্রেতারা।
গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে মাঝারি ধরনের চালের (পাইজাম ও লতা) দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকার মতো। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে প্রতি কেজি মাঝারি ধরনের চালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত সপ্তাহে যে চাল তারা বিক্রি করেছেন ৫৬ টাকা কেজি দরে, এই সপ্তাহে সেই একই চাল বিক্রি করছেন ৫৮ টাকা কেজি দরে।
চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৩ থেকে ৭৫ টাকা, আটাশ ৫৫ থেকে ৫৮, নাজিরশাইল ৮৩ থেকে ৯১, মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫৫, চিকন চাল ৭০ থেকে ৮০, কাটারি ৬০ থেকে ৬৫ এবং পোলাওর চাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি দরে।
নতুন করে বেড়েছে আটার দামও। প্যাকেট আটা গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেছেন ৫৮ টাকা কেজি দরে। এই সপ্তাহে সেই একই আটা বিক্রি করছেন ৬০ টাকা কেজিতে। এছাড়া গত সপ্তাহে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া আটা এই সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৬৩ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে বেড়েছে তিন টাকার মতো।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত সপ্তাহে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ময়দা এই সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকা কেজি দরে।
টিসিবির হিসাবে বড় দানা মসুর ডালের (তুরস্ক ও কানাডা) দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মাঝারি ধরনের মসুর ডালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। এছাড়া গত এক সপ্তাহে দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আমদানি করা রসুন ১২০ থেকে ১৩০ টাকা ও আদা ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি আলু ৩০ টাকার বেশি।
গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে নতুন করে বেড়েছে চিনির দাম। চলতি সপ্তাহ থেকে বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্যবসীয়ারা। তবে এর কোনো প্রভাব নেই। এখনও নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাজারে পৌঁছায়নি সরকার-নির্ধারিত দামের চিনি। যদিও গত সোমবার (২৪ অক্টোবর) ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) থেকে সরকার-নির্ধারিত দাম, অর্থাৎ প্রতি কেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনি ৯৫ টাকায় বিক্রি করা হবে। বাজারে চিনির সংকট থাকবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন তারা। এরপর পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও বাজারে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়।
এদিকে নতুন নতুন শীতকালীন সবজি বাজারে এলেও দামও চড়া। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ে অনেক কৃষকের সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। ফলে বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ কিছুটা কম। এ কারণে দামও এখন চড়া।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে চিচিঙ্গা, বেগুন, পটল, ঢ্যাঁড়স ও কাঁকরোলসহ প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে অন্তত ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অবশ্য প্রতি কেজি পেঁপে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এটি বাজারের মধ্যে সবচেয়ে কম দামি সবজি।
এছাড়া পটোল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা, লম্বা বেগুন ৭০ থেকে ৮০, গোল বেগুন ৫০ থেকে ৬০, ঢ্যাঁড়স ৬০, শিম ১০০ থেকে ১২০, টমেটো ও গাজর ১৪০, বরবটি ৯০ থেকে ১০০, করলা ৬০ থেকে ৬৫, ফুলকপি প্রতি জোড়া ১৩০, বাঁধাকপি ৬০, লাউ ৪০ থেকে ৭০, শসা ৬০, কচুর লতি ৭০ থেকে ৮০, মানভেদে কাঁচা মরিচ ১০০, মুলা ৬০ ও চিচিঙ্গা ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজন ১৫০ টাকা, হাঁসের ডিম ২১০ আর দেশি মুরগির ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায়। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০ থেকে ১৯০, পাকিস্তানি কক ৩২০, দেশি মুরগি ৫৩০ থেকে ৫৫০ ও দেশি হাঁস ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছের বাজারে দেখা যায়, প্রতি কেজি রুই ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা, কাঁচকি ৭০০, পাবদা ৬০০, রূপচাঁদা ১ হাজার ১০০ এবং তেলাপিয়া ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাড়তি দামে সবজি কিনে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। আর বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে বেশি দাম যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। দাম কমতে শীত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, লাউ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়, বাঁধা কপি, ফুলকপি (ছোট) ৩০-৩৫ টাকা পিস, টমেটো ১৪০ টাকা কেজি, কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শিম প্রতি কেজি ১০০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া কেজি ৫০ টাকা, পটোল ৫০ টাকা, বেগুনের কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, করোলা ৮০ টাকা কেজি, ঢ্যাঁড়স প্রতি কেজি ৭০ টাকা, শসা ১০০ টাকা, ঝিঙ্গার প্রতি কেজি ৬০ টাকা। ৫০ টাকার নিচে পাওয়া গেলে একমাত্র পেঁপেই। পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে।
মহাখালী বাজারে সাপ্তাহিক বাজার করতে এসেছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আনোয়ার হোসেন। বিক্রেতার সঙ্গে সবজির দামাদামি করার সময় তার চোখে-মুখে এক ধরনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠছিল। কারণ বাজারের এই ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তিনি পেরে উঠছেন না।
কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই বাজারে কম টাকার মধ্যে কিছুই কেনা যায় না। এমন কোনো জিনিস নেই বাজারে যার দাম বাড়তি না। এই পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বহন করে টিকে থাকাই কঠিন। বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। যেটার দাম করি সেটাই ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এছাড়া শিম, শসা তো ১০০ আর টমেটো ১৪০ টাকা। বাজারে গরিবের সবজি বলতে শুধু পেঁপে আছে, যার দাম ৩০-৪০ টাকা। তাহলে বলেন আমরা খাব কী?
সবজি বিক্রেতা আফসার আলী বলছেন, আসলেই বাজার বাড়তি যাচ্ছে। পাইকারি বাজারেও প্রতিটি জিনিস আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এরপর আমাদের তা পরিবহনে করে এনে শ্রমিক দিয়ে নামাতে হয়। ফলে এর দাম আরও বেশি পড়ে যায়, এছাড়া পাইকারি বাজার, এই বাজার সব মিলিয়ে একটা লাইন ফি দিতে হয়। সব মিলিয়ে ক্রেতা পর্যায়ে আসতে একটা পণ্যের দাম বেড়ে যায়। মৌসুম শেষের দিকে তাই বর্তমান বাজার একটু বাড়তি যাচ্ছে।
রাজধানীর মালিবাগ এলাকার কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মোজাম্মেল হক বলেন, আগের ফলনের বেশিরভাগ ফসলের শেষ চালানের মাল এগুলো। শীত এলে সব নতুন সবজি উঠবে তখন দাম কমে আসবে। তাই সবজির দাম আসতে শীত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নতুন সবজি আসার পর বাজার কমতে ২-৩ সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে।