সারের বাজারে নতুন কৌশল: ডিলাররা হতাশ, কৃষকরা উদ্বেগে
নভেম্বর ০৮ ২০২৫, ১৮:০১
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সার বিক্রিতে এ ধরনের উৎস কর বা অতিরিক্ত চার্জ কখনো আরোপ করা হয়নি। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে, অর্থাৎ ৩০ জুন পর্যন্ত এই নিয়ম কার্যকর ছিল না। হঠাৎ করেই জুলাই ২০২৫ থেকে প্রতিটি সারের বস্তায় উৎস কর যোগ হওয়ায় ডিলারদের ব্যয় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
চুয়াডাঙ্গার এক অভিজ্ঞ সার ডিলার জানান, আগে আমরা সরকারি নির্ধারিত দামে সার তুলতাম। এখন এক বস্তা টিএসপি সার তুলতে সরকারি জমা দিতে হয় ১,২৫০ টাকা, এর সঙ্গে উৎস কর যোগ হয়েছে আরও ৩ টাকা ১৩ পয়সা। ডিএপি সারের বাবদ জমা দিতে হয় ৯৫০ টাকা তার সাথে উৎস কর ২ টাকা ৩৮ পয়সা , এমওপি সারে জমা দিতে হয় ৯০০ টাকা উৎস কর ২ টাকা ২৫ পয়সা ।শুধু এটুকুই নয়—নওয়াপাড়া থেকে সার আনতে লোড, আনলোড, লেবার, পরিবহন ও অন্যান্য খরচে ব্যয় হয় আরও অন্তত ২০ থেকে ২৫ টাকা প্রতি বস্তায়।
তিনি বিস্তারিত হিসাব তুলে ধরে বলেন, এক বস্তা সার তুলতে লোডিং চার্জ লাগে ৪ টাকা, লেবার বকশিশ প্রতি ট্রাকে ৫০০ টাকা, তামালি দিতে হয় ৩০০ টাকা, ট্রান্সপোর্টে লাগে আরও ৩০০ টাকা। ডিলার পয়েন্টে আনলোড করতে প্রতি বস্তায় ৪ টাকা লেবার খরচ, আবার আনলোড বকশিশ দিতে হয় ৩০০ টাকা, সঙ্গে ট্রাকভাড়া প্রায় ১৩,৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে এক বস্তা সার বাজারে তুলতে আমাদের প্রকৃত খরচ দাঁড়ায় প্রায় ১,৩০০ টাকার কাছাকাছি।
একজন ডিলার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী নিয়মিত সার তুলি। কিন্তু এত খরচের পরও লাভ থাকে না বললেই চলে। এখন তো প্রতিমাসে সরকারি বরাদ্দের সার তুলতে গেলেই সরকারি খাতে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা জমা দিতে হয়। এত বড় ইনভেস্টমেন্ট করে যদি কোনো লাভ না থাকে, তাহলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
ডিলারদের অনেকেই বলেন, সার বিক্রির মূল কাজটা এখন আর ব্যবসা নয়, যেন একরকম সামাজিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। তারা বাধ্য হয়ে সার বিতরণ করেন যাতে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন। কিন্তু নিজেদের আর্থিক ক্ষতির কারণে ডিলাররা একপ্রকার হতাশা ও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
চাষি আবু বক্কর জানান, যে ডিলার এত টাকা খরচ করে সরকারি সার আনছে, সে তো বিনা লাভে সার বিক্রি করতে পারবে না। বাধ্য হয়েই তারা কিছুটা দাম বাড়াবে। এতে আমাদের খরচ বাড়বে। একসময় ফসল উৎপাদনের ব্যয় এমন পর্যায়ে যাবে যে কৃষকের পক্ষে মুনাফা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, সরকার কৃষকের স্বার্থে ভর্তুকি দেয়, কিন্তু বাস্তবে সেই সুবিধা অনেক সময় মাঠপর্যায়ে পৌঁছায় না। যদি ডিলারদের উপর এমন করের চাপ দেওয়া হয়, তাহলে শেষমেশ ক্ষতির মুখে পড়বে কৃষকরাই।
একজন সার আমদানিকারক বলেন, আমরা যখন সার আমদানি করি, তখনই সরকারের শুল্ক, কর, ভ্যাট-সবকিছু পরিশোধ করি। এর পরেও ডিলারদের কেন উৎস কর দিতে হবে, তা আমাদের কাছে অজানা। এভাবে দ্বৈত করের বোঝা দিলে সার ব্যবসা ব্যাহত হবে।
তার মতে, সরকারের উচিত হবে এই দ্বৈত কর কাঠামো পুনর্বিবেচনা করা। সারের বাজারে এমন সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেওয়া হলে শুধু ডিলার নয়, কৃষি খাতের সার্বিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ সারের দাম সামান্য বাড়লেই কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, যা সরাসরি ভোক্তা বাজারে প্রভাব ফেলে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সার বিক্রিতে উৎস কর আরোপের সিদ্ধান্ত মূলত রাজস্ব আহরণের একটি সীমিত প্রক্রিয়া, যা সরকারের সার ভর্তুকি ব্যয় আংশিকভাবে পুষিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
এক কৃষি কর্মকর্তার ভাষায়, কৃষকের সার ভর্তুকিতে প্রতিবছর সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। সামান্য উৎস করের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় কিছুটা বাড়বে, যা ভবিষ্যতে কৃষকদের সহায়তা করতেই ব্যয় হবে। তবে কৃষকের উপর যেন বোঝা না পড়ে, সেটিই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
তবে মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি অন্যরকম। সরকারি নীতিতে বলা হয়েছে, উৎস করের হার সামান্য এবং তা ডিলারের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে জমা হবে। কিন্তু বাস্তবে এই কর ও অতিরিক্ত খরচের পুরো চাপ পড়ছে ডিলারদের ঘাড়ে। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছেন সার বিক্রিতে সামান্য দাম বাড়াতে, যা শেষ পর্যন্ত কৃষকের পকেট থেকেই যাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা—এসব জেলায় মাঠপর্যায়ের কৃষকরা বলছেন, গত মৌসুমের তুলনায় সার কিনতে এখন প্রতি বস্তায় ১৫–২০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে
বর্তমানে দেশের গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত সার মজুদ আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে কোনো সার ঘাটতি নেই। সরকার আগাম আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় যথেষ্ট প্রস্তুত।
তবুও ডিলার ও কৃষকদের মনে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, যদি এই করনীতি বহাল থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে সারের বাজারে দালালচক্র সক্রিয় হয়ে যেতে পারে। এতে করে অনেকে সরকারি বরাদ্দের সার তুলতে নিরুৎসাহিত হবে, যার প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদনে।
অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশ্লেষকদের মতে, এখানে মূল সমস্যা উৎস কর নয়, বরং স্বচ্ছতার অভাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, সরকার চাইলে উৎস করের হার অপরিবর্তিত রেখেও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনতে পারে। লোডিং, আনলোডিং, পরিবহন ও অতিরিক্ত খরচের জটিলতা কমালে ডিলারদের ব্যয় অনেকটা হ্রাস পাবে।
তিনি আরও বলেন, সার ব্যবসা শুধু মুনাফার বিষয় নয়—এটা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাই সরকারের উচিত হবে এই খাতকে অযথা করের জালে না ফেলে কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
চুয়াডাঙ্গার এক প্রবীণ ডিলার বলেন, আমরা সরকারি সার বিক্রির মাধ্যমে দেশের কৃষককে সহায়তা করি। কিন্তু প্রতিনিয়ত নতুন নিয়ম, নতুন কর, আর নানা দালালি খরচ আমাদের দম বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকার যদি এই খাতের বাস্তবতা বুঝে উৎস কর পুনর্বিবেচনা করে, তাহলে আমরা আবার আগের মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারব।
বাংলাদেশের কৃষি আজ অনেক এগিয়েছে—প্রযুক্তি, বীজ, সেচ সবখানেই অগ্রগতি। কিন্তু সারের মতো মৌলিক উপাদানে যদি ডিলার ও কৃষক উভয় পক্ষের মধ্যে অনিশ্চয়তা থেকে যায়, তাহলে সেই উন্নয়ন স্থায়ী হবে না।
সরকারের উচিত হবে সার বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, অপ্রয়োজনীয় কর বা খরচ পুনর্বিবেচনা করা এবং মাঠপর্যায়ে কৃষকের হাতেই প্রকৃত সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। তবেই সার হবে সত্যিকার অর্থে ‘ফসলের প্রাণ’—ডিলার, কৃষক ও সরকারের মধ্যে বিশ্বাসের সেতুবন্ধন হয়ে উঠবে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির টেকসই ভিত্তি।









































