বরিশালকে শত্রু মুক্ত করতে যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমএ হক
আজ ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস
ডিসেম্বর ০৮ ২০২৫, ১৪:২৪
বরিশাল : বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে আজ ৮ ডিসেম্বর বরিশাল শহর শত্রু মুক্ত হয়েছিলো। সেই যুদ্ধে বৃহত্তর বরিশালের ৯নং সেক্টরের সহ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ হক বীর বিক্রম।
বরিশাল মুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে স্মৃতিচারন করে এমএ হক বীর বিক্রম জানিয়েছেন সেই যুদ্ধ দিনের কথা। এমএ হক বীর বিক্রম বলেন-ভোলা, ঝালকাঠিসহ ৯নং সেক্টরের বৃহত্তর বরিশাল সাব সেক্টরের সবকয়টি উপজেলা শক্রমুক্ত করার পর ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর আমাদের গোয়েন্দা এবং বরিশালের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আইউবুর রহমানের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানিতে পারি যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া অঞ্চলের পাক হানাদার বাহিনী নদী পথে ঢাকা যাবার জন্য বরিশাল শহরের ওয়াবদা কলোনী ও ৩০ গোডাউন এলাকায় একত্রিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসক গোপন সংবাদে জানিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বিকেল তিনটার দিকে জেলা প্রশাসকের অফিসে একটি সংক্ষিপ্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় হানাদার বাহিনীর উচ্চ পদস্ত অফিসারগণ উপস্থিত ছিলেন। তাহারা ১৬টি নৌযান (ছোট বড় লঞ্চ) জব্দ করে বরিশাল শহরের নেভাল জেটিতে ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে হাজির করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।
এমএ হক বীর বিক্রম আরও বলেন-আমরা জানতে পারি ওই নৌযানে প্রায় এক ব্রিগেট হানাদার সৈন্য ৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ভাড়ি অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ৮ ডিসেম্বর সকাল ছয়টার মধ্যে ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা করবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর সাব সেক্টরের টাউন সুইসাইডাল কমান্ডার রেজাই সত্তার ফারুকের মাধ্যমে সাব সেক্টরের সকল বেইজ কমান্ডারদের নিয়ে বরিশাল শহরের কীতনখোলা নদীর পূর্ব তীরে সাহেবেরহাটের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমরসহ আমি একটি সংক্ষিপ্ত সভা করি।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয় ভাড়ি অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় এক ব্রিগেট হানাদার সৈন্য (আনুমানিক ৮ থেকে ৯শ’) জনকে আক্রমন করার মতো অস্ত্র আমাদের কাছে নেই। যুদ্ধ বিমানের আক্রমন ছাড়া হানাদারদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি বরিশাল শহরের একমাত্র ওয়াপদা কলোনী ও ৩০ গোডাউন এলাকা ছাড়া পুলিশ লাইনের উত্তরের অংশ সম্পূর্ন শত্রু মুক্ত রয়েছে বিধায় বরিশাল শহরের সার্কিট হাউজে ওঠা সম্ভব।
সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়েছিলো-বরিশাল পুলিশ লাইনের ওয়ার্লেস ভালো থাকলে খুলনা যেহেতু শত্রু মুক্ত আছে সেখানে যোগাযোগ করে ৯নং সেক্টর কমান্ডার এমএ জলিল এবং দক্ষিন বাংলার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল ইসলাম মঞ্জুর সাথে কথা বলে বিমান সাপোর্ট পাওয়া গেলে উক্ত বাহিনীকে র্ধ্বংস করা সম্ভব হবে।
এমাতবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোর ছয়টার দিকে আমরা বরিশাল শহরের উত্তর পার্শ্বের নতুন বাজার খাল দিয়ে সতর্কতার সহিত বরিশাল শহরের সার্কিট হাউজে গিয়ে উঠি। পরবর্তীতে আমি (এমএ হক) সহ টাউন সুইসাইডাল স্কট কমান্ডার রেজাই সত্তার ফারুক পুলিশ লাইনে গিয়ে দেখতে পাই সেখানকার ওয়্যারলেসের যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে।
এরপর ব্যাটারী এবং যন্ত্রাংশ সংযোজন করিয়া যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হই। পরবর্তীতে সার্কিট হাউজে এসে সেখানে অবস্থানরত সাবসেক্টর কমান্ডারের কাছে বিস্তারিত অবহিত করি। তিনি বলেন আমাকে ওয়ার্লেসের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। কারণ তিনি ছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিগনাল কোরের অফিসার। তাকে নিয়ে পুণরায় ওয়ার্লেসে নিয়ে যাই। তিনি ওয়ার্লেস অপারেট করেন এবং খুলনার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার এমএ জলিলকে সেটে আসার জন্য অনুরোধ করেন।
কিছু সময়ের মধ্যে সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলের সাথে ওয়ার্লেসে কথা হয়। তাকে ৮ ডিসেম্বর সকাল ছয়টার মধ্যে নৌযানের মাধ্যমে ভাড়ি অস্ত্রে সজ্জিত হইয়া পাক সেনাদের ঢাকার উদ্যেশ্যে যাত্রা করার বিষয়ে অবহিত করে এয়ার সাপোর্ট চাওয়া হয়।
তখন মেজর এমএ জলিল শুধু উত্তরে বলেছিলেন-অপেক্ষা করো, আমি নুরুল ইসলাম মঞ্জু ভাইয়ের মাধ্যমে এয়ার বেইজ ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ করে জানাচ্ছি। পরবর্তীতে ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে মেজর এমএ জলিল জানান, ইন্ডিয়ান এয়ার বেইজের তিনখানা ফাইটার জেট ৮ ডিসেম্বর সকাল ছয়টার মধ্যে কীর্তনখোলা নদীর উত্তরে নন্দীর বাজার পর্যন্ত এলাকায় আক্রমন চালাবে। তোমরা বরিশাল শহরের উচ্চস্থানে শান্তির প্রতীক সাদা পতাকা উড়িয়ে দিবে এবং নদীর দুই তীরে মুক্তিযোদ্ধাদের মোতায়েন করে রাখবে। যখনই বিমান হামলা শুরু হবে সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারাও পাকসেনাদের নৌ-যানের ওপর আক্রমন করিবে।
এমএ হক বীর বিক্রম আরও বলেন-উক্ত সংবাদের পর আমরা ৮ ডিসেম্বর ভোর থেকে বরিশাল শহরে ১৪৪ ধারা জারি করি এবং শহরের উচ্চস্থানগুলোতে সাদা পতাকা উড্ডয়ন করি। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের নদীর দুই তীরে অবস্থান করার জন্য নির্দেশ প্রদান করে অপেক্ষা করতে থাকি। ৮ ডিসেম্বর ভোর ছয়টার দিকে হানাদার বাহিনীর নৌ-বহর যখন নেভাল জেটি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তখন আমরা চরম বিব্রত বোধ করি।
কারণ তখন ইন্ডিয়ান ফাইটারদের আঘাত হানার কথা কিন্তু কোথাও তাদের দেখা যাচ্ছেনা। এদিকে হানাদার বাহিনীর বিশাল নৌ-বহর এগিয়ে চলছে। হঠাৎ করে ৬ টা তিন মিনিটের সময় দক্ষিণ আকাশে তিনখানা ফাইটার জেট দেখা যায়। প্রথমে বরিশালের শহরের উপর দিয়ে ওই ফাইটার জেট প্রদক্ষিন করে প্রথমে টার্মিনালে একটি বোমা নিক্ষেপ করে সোজা দক্ষিণ দিকে চলে যায়। মুহুর্তের মধ্যে পুনরায় নৌ-বহরের উপর তিনটি ফাইটার জেট চড়াও হয়।
প্রথম ফাইটারটি ব্রাস্ট ফায়ার, দ্বিতীয়টি বোমা নিক্ষেপ, তৃতীয়টি ব্রাস্ট ফায়ার করতে থাকে। একই সময় নদীর দুই তীর থেকেও মুক্তিযোদ্ধারা নৌ-বহরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। এভাবেই ২০মিনিটের যুদ্ধে পাক সেনাদের নৌ-বহর সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে যায়।
হানাদার সৈন্যদের মধ্যে যারা নদী সাঁতরিয়ে কিনারে ওঠার চেষ্টা করে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে হত্যা করে। এভাবেই ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল পাক হানাদার মুক্ত হয়। সেদিন বরিশাল শহরের আপামর জনসাধারণ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠেন।
মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বরিশালের সাব সেক্টরের সহ-অধিনায়ক এমএ হক বীর বিক্রম আরও বলেন-বরিশাল মুক্ত দিবসে শত্রু মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল ইসলাম মঞ্জু এবং ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন।









































