টিসিবি দেশের বাজার অর্থনীতির একটি স্থিতিশীলতার স্তম্ভ
সেপ্টেম্বর ২১ ২০২৫, ১৬:০২
বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি প্রায়শই বৈশ্বিক অর্থনীতি, আমদানি-রপ্তানি ব্যয়, মৌসুমভিত্তিক সরবরাহ সংকট এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোক্তা বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায্য দামে জরুরি পণ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
টিসিবি একটি সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা, যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ।
এটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি, সরবরাহ ও ন্যায্য মূল্যে বিক্রির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে টিসিবি শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানি করে এবং কিছু পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েও অবদান রাখে।
টিসিবির প্রধান কার্যক্রম
যখন বাজারে কোনো পণ্যের সরবরাহ কমে যায় বা দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন টিসিবি জরুরি ভিত্তিতে চাল, ডাল, চিনি, সয়াবিন তেল, ছোলা, পেঁয়াজ, লবণ ইত্যাদি আমদানি করে। পরে সেগুলো ট্রাকসেল, ফ্যামিলি কার্ড ও ডিলারের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে ন্যায্য দামে বিক্রি করে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বাজারে অযৌক্তিক দামের চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পায়।
বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রম
টিসিবি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে পথিকৃৎ সংস্থা। প্রতিষ্ঠানটি শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিই নয়, পাট, চা, কিছু কৃষিজাত পণ্য এবং অন্যান্য রপ্তানি যোগ্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
মানবিক সহায়তা কার্যক্রম
দুর্যোগকালীন সময়ে যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারি বা অন্য কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে টিসিবি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করে থাকে। এই কার্যক্রমে টিসিবি সরকারের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
সরকারি নীতি বাস্তবায়ন
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে টিসিবি সীমিত আয়ের মানুষের কাছে ন্যায্য মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে জনগণের ভোগ্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা হলেও ধরে রাখা সম্ভব হয় এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
শিল্পের কাঁচামাল আমদানি
শুধু ভোক্তা পণ্য নয়, প্রয়োজনে শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানির কাজও করে টিসিবি। এর ফলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয় না এবং কর্মসংস্থান বজায় থাকে।
স্মার্ট কার্ড বিতরণ ও আধুনিকায়ন
বর্তমানে টিসিবি তার কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করছে। ‘ফ্যামিলি কার্ড’ বা স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগী পরিবারগুলিকে শনাক্ত করে তাদের কাছে নির্দিষ্ট কোটা অনুযায়ী ন্যায্য মূল্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এটি দুর্নীতি, কালোবাজারি এবং অনিয়ম রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
টিসিবির কার্যক্রম সরাসরি বাজার স্থিতিশীলতা ও জনগণের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সম্পর্কিত। যখন বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়, টিসিবির সরবরাহ সেই ধাক্কা কিছুটা হলেও সামাল দেয়। এর ফলে কৃত্রিম সংকট বা মজুতদারির প্রভাব হ্রাস পায়।
অন্যদিকে, নিম্ন আয়ের মানুষ বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশাচালক, গার্মেন্টস কর্মী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী টিসিবির কার্যক্রম থেকে সরাসরি উপকৃত হয়। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং বাজারে অতিরিক্ত চাপ কমে।
টিসিবির চ্যালেঞ্জ
যদিও টিসিবি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তবুও এর কার্যক্রমে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বাজেট ঘাটতি: বড়ো আকারের আমদানি কার্যক্রম চালাতে অনেক সময় বাজেট সংকটে পড়ে টিসিবি।
অপর্যাপ্ত ডিলার নেটওয়ার্ক: প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিলার সংখ্যা সীমিত হওয়ায় অনেক মানুষ টিসিবির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব: আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক সময় আমদানি প্রক্রিয়ায় দেরি হয়।
পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল: আমদানিকৃত পণ্য সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে পৌঁছাতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে বিলম্ব বা লজিস্টিক সমস্যা দেখা দেয়।
সরকার ইতিমধ্যে টিসিবির সক্ষমতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে—
ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা: পণ্য বিতরণে স্মার্ট কার্ড সিস্টেম চালু করা হয়েছে।
ডিলার নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ: নতুন ডিলার নিয়োগ ও বিক্রয় পয়েন্ট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্টক মজুদ বাড়ানো: সংকটকালীন সময়ের জন্য পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তুলতে গুদামজাতকরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন চলছে।
দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা: বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দ্রুত আমদানির জন্য জরুরি তহবিলের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ কেবল একটি সরকারি আমদানি সংস্থা নয়; এটি দেশের বাজার অর্থনীতির একটি স্থিতিশীলতার স্তম্ভ। সংকটময় সময়ে টিসিবি সরকারের শেষ অবলম্বন হিসেবে কাজ করে এবং জনগণের ন্যায্য ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে।
ভবিষ্যতে আরও দক্ষ ব্যবস্থাপনা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ডিজিটাল সিস্টেমের সম্প্রসারণ এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে টিসিবি দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এটি জনকল্যাণমূলক অর্থনীতির একটি সফল উদাহরণ হয়ে থাকবে।









































