আজ থেকে ৮ মাসের জন্য জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞা
নভেম্বর ০১ ২০২২, ০০:০৬
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নিরাপদ প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপননে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের তিনদিন পরেই সারা দেশে জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে গত মধ্যরাতে। ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ৬টি অভয়াশ্রম সহ সারা দেশেই ১০ ইঞ্চির নিচে সব ধরনের ইলিশপোনা-জাটকা আহরণ, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকবে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে আশি^নের বড় পূর্ণিমার সময়কালকে বিবেচনায় নিয়ে গত ৬ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৮ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত উপকুলের ৭ বর্গ কিলোমিটারের প্রধান প্রজননস্থলে সব ধরনের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সারা দেশেই ইলিশের আহরণ,পরিবহন ও বিপনন বন্ধ ছিল। জাটকা আহরণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতেও দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় ভ্রাম্যমান আদালত এবং মৎস্য বিভাগের অভিযানে নৌবহিনী, কোষ্ট গার্ড, পুলিশ ও র্যাব সহ বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনী নজরদারী সহ সার্বিক সহায়তা করবে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে সক্ষম। জীবনচক্রে ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরণ করে থাকে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে কিছুটা বড় হয়ে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই প্রজননক্ষম ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় ইলিশ পোনাÑজাটকা খাদ্য গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহিৃত করে অভয়াশ্রম ঘোষনা করা হয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীগনের সুপারিশে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জের লতা, নয়া ভাঙ্গনী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুুলিয়া নদীর ১শ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে ভোলার চর ইলিশা হয়ে চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, শরিয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ নিম্ন পদ্মার ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত মোট ৬টি অভয়াশ্রমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ইলিশ আহরন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করায়ও উৎপাদন বাড়ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে সারা দেশে উৎপাদিত ও আহরিত ইলিশের ৬৮Ñ৭০ ভাগই দক্ষিনাঞ্চলে সম্পন্ন হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, দেশে এখনো নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জাল সহ অন্যান্য ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ উপকরনের সাহায্যে যে পরিমান জাটকা আহরণ হচ্ছে, তার এক-দশমাংশ রক্ষা করা গেলেও বছরে আরো অন্তত ১ লাখ টন ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেত। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল ও বেহুন্দি জাল সহ অন্যন্য ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ উপকরনের ব্যবহার বন্ধে আরো কঠোর নজরদারী সহ তা জিরো টলারেন্স-এর কোন বিকল্প নেই।
তবে আহরণ নিয়ন্ত্রন সহ নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে জাটকা’র উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯,২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। যা পরবর্তী বছরগুলোতেও আনুপাতিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদনও গত দুই দশকে প্রায় ৩ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ৫.৬৫ লাখ টন থেকে চলতি বছর পৌনে ৬ লাখ টনে উন্নীত হবার আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর। সারা বিশে^ উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৬৫Ñ৭০% বাংলাদেশে উৎপাদন ও আহরিত হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী।
আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২%। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের ফলে ২০১৮ সালে দেশে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি উৎপাদিত ডিমের ৫০%-এর সাফল্যজনক পরিস্ফূটন সহ তার ১০% বেঁচে থাকলেও ইলিশ পরিবারে নতুন ৩ হাজার কোটি জাটকা যুক্ত হয়। ২০১৯ সালে মূল প্রজনকালীন সময়ে দেশের প্রধান ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র সমূহে পরীক্ষামূলক নমুনায়নে ৮৩% ইলিশের রেনুর পাশাপাশি ১৭% অন্যান্য মাছেরও রেনু পোনা পাওয়া যায়।
এদিকে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ ও জীব বৈচিত্র্যকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ২০১৯-এর ২৬ জুন থেকে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এবারো আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে জাটকার ওপর জীবিকা নির্ভরশীল জেলেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার ৪০ কেজি করে চাল বিতরণ করবে বলে জানা গেছে। গত বছর শুধু দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৪ লাখ জেলে পরিবারের মধ্যে দুই ধাপে ৪০ কেজি চাল বিতরণ করা হয়েছিল।